মনুর বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার শহরের একাংশ প্লাবিত

মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকার রাস্তা ডুবে গেছে। মৌলভীবাজার, ১৭ জুন। ছবি: আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকার রাস্তা ডুবে গেছে। মৌলভীবাজার, ১৭ জুন। ছবি: আকমল হোসেন

মনু নদের বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার শহরের একাংশ প্লাবিত হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মৌলভীবাজার পৌরসভার বারইকোনা এলাকায় এই ভাঙন দিয়েছে। এতে মৌলভীবাজার পৌরসভার পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের তিনটি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এলাকার অনেক বাসাবাড়িতে প্রায় বুকসমান পানি।

এদিকে মনু নদে পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বারইকোনার ভাঙনের কারণে ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ থেকে হিলালপুর এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকায় এই সড়ক দিয়ে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলের কারণে মনু নদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে পৌরসভার বারইকোনা এলাকায় প্রায় ৪০ ফুট এলাকাজুড়ে ভাঙন দিয়েছে। প্রথমে এই স্থানে একটি ছিদ্র ধরা পড়ে। ছিদ্র দিয়ে শহরের দিকে চুঁইয়ে পানি ঢুকছিল। তাৎক্ষণিকভাবে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়াও হয়। কিন্তু এই মেরামতের আগেই বাঁধ ভেঙে শহরের পশ্চিমাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে করে শহরের বড়হাট, বারইকোনা, ধরকাপন, বরকাপন, দ্বারক, হিলালপুরসহ পৌরসভার ৬, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তীব্র বেগে এসব ওয়ার্ডের সড়ক ও নালা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

মৌলভীবাজার শহরের রাস্তায় নেমেছে নৌকা। বড়হাট, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
মৌলভীবাজার শহরের রাস্তায় নেমেছে নৌকা। বড়হাট, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

আজ রোববার সকালে বড়হাট, দ্বারক এলাকায় দেখা গেছে, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে বুকসমান, গলাসমান পানি। লোকজন পানি ঠেলে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে বেরিয়ে আসছে। অনেকে ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ যা বহন করতে পারছে, তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। অনেকে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে উঁচু স্থানের দিকে ছুটছে। পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারের জন্য অনেকে গাড়ি দিয়ে নৌকা নিয়ে আসছে। মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকা থেকে হিলালপুর এলাকা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঊরুসমান পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সড়কের এই অংশে নৌকা চলছে। রাতের বেলা হওয়ায় অনেক পরিবারের পক্ষেই মালামাল সরানো সম্ভব হয়নি।

পশ্চিম বড়হাট এলাকার মো. কুরেশ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাসার কাছেই বাঁধ ভেঙেছে। প্রথম সুরুং (ছিদ্র) হয়েছে। বন্ধ করতে পারে নাই। ভেঙে গেছে।’ তিনি জানান, এলাকার লোকজন বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদে রাত কাটিয়েছেন। তাঁর পরিবারও একটি বাসার ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি গলাসমান পানি সাঁতরে খাবারের খোঁজে বেরিয়ে এসেছেন।

পানি ভেঙে ছুটতে ছুটতে ঊর্মি রানী দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘর থেকে কিচ্ছু বার করতে পারিনি। ফ্রিজ, টিভি, সোফা, সবকিছু পানিতে ভাসছে।’

এদিকে শহরের কুসুমবাগ এলাকা থেকে পূর্ব দিকে শহরের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র পশ্চিম বাজারের দিকে নালা ও সড়ক দিয়ে পানি ঢুকছে। এতে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন।

জেলার খাদ্যগুদামের সামেন পানি। কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
জেলার খাদ্যগুদামের সামেন পানি। কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

শহরের ধরকাপন এলাকার বাসিন্দা ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম উমেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়িতে পানি। পৌরসভার ৬, ৯ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড বন্যাকবলিত। এলাকার সড়কের ওপর দিয়ে তীব্র বেগে পানি ছুটছে।’

মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও হিলালপুর এলাকার বাসিন্দা সালেহ এলাহী কুটি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পানিবন্দী হয়ে পড়েছি। বাড়িতে পানি উঠেছে।’

এ ছাড়া ভাঙনের পানিতে কুসুমবাগ এলাকায় দুটি ও উপজেলা পরিষদ এলাকায় দুটি খাদ্যগুদামে পানি উঠেছে। এ চারটি গুদামে ১ হাজার ৫৬৮ মেট্রিক টন চাল ও ৪২৪ মেট্রিক টন গম আছে। গুদামে রক্ষিত বস্তার তিন থেকে চারটি স্তর পানিতে তলিয়ে গেছে।

ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনোজ কান্তি দাস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত থেকেই গুদাম এলাকাতে আছি। এই অবস্থায় পানি বেশিক্ষণ থাকলে চাল-গম নষ্ট হয়ে যাবে। আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছি।’

গুহপালিত পশু নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছে বন্যায় আক্রান্ত মানুষ। কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
গুহপালিত পশু নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছে বন্যায় আক্রান্ত মানুষ। কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার ১৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

এদিকে মনু ও ধলাই নদের পানি কমতে শুরু করেছে। ধলাই নদের পানি বিপৎসীমার নিচে চলে এসেছে। আজ সকালে শহরে কাছে চাঁদনীঘাটে মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি একটু একটু করে কমছে।

মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পৌরসভার গাড়ি, লেবার, কয়েক হাজার বস্তা দিয়ে বাঁধ ঠেকানোর কাজ করেছি। এরপরও বারইকোনার দিকে ভেঙে গেছে। তবে এই পানি শহরের পূর্ব দিকে যাওয়ার কথা না।’

পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ ফুটের মতো বাঁধ ভেঙেছে। তবে যত সময় যাবে ভাঙনের পরিমাণ বাড়বে। যেখানে ভেঙেছে, তার ওপর দিয়ে পাকা সড়ক। রাত ১১টার দিকে লিকেজ ধরা পড়েছে। কিন্তু মেরামত করার আর সময় মেলেনি। তার আগেই ভেঙে গেছে। এই পানি হাইল হাওরের দিকে চলে যাবে। তবে মনুতে পানি কমছে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’