নাজনীনের তৈরি পাপেট, কস্টিউম নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়

সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের পণ্য। ছবি: সংগৃহীত
সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের পণ্য। ছবি: সংগৃহীত

বন্ধুদের উপহার দিতেই গিয়েই এ কাজে হাতেখড়ি তাঁর। স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধব যখন একে অন্যকে উপহার দেওয়ার জন্য বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দোকানে ছুটোছুটি করতেন, তখন তিনি মাথা গুঁজে নিবিষ্টভাবে বন্ধুদের জন্য যত্ন নিয়ে উপহার তৈরি করতেন। কাপড় দিয়ে পুতুল বানাতেন, মোমের ওপর নানান দৃশ্য আঁকতেন। তাঁর বানানো উপহার হাতে পেয়ে বন্ধুদের বিস্ময়ভরা উচ্ছ্বাস প্রকাশই তাঁকে আনন্দ দিত।

নব্বইয়ের দশকে এভাবেই শুরু করার গল্পটি প্রথম আলোকে বলছিলেন নাজনীন আনসারী। সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের স্বত্বাধিকারী। তাঁর ব্যথা, এই আনন্দ পেতে ব্যবসায়ী বাবা মির্জা আনসার উদ্দীন বেগকে অনেকে ‘জ্বালিয়েছেন’। বাবাকেই টাকা খরচ করে পুতুল বানানোর কাপড়সহ অন্যান্য উপকরণ আর মোম কিনে দিতে হতো। তবে কাজটিতে বাবাই বেশি উৎসাহ দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। মা রাবেয়া বেগ বেঁচে থাকতে উৎসাহ জুগিয়েছেন।

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তরুণী হওয়ার পরও মূলত উপহার দেওয়ার জন্যই হাতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতেন। বন্ধুদের নবজাতক সন্তানদের জন্য পোশাক তৈরি করে উপহার দিতেন। তবে এখন নাজনীনের তৈরি পণ্য কিনে উপহার দেন দেশি-বিদেশি ক্রেতারা। তাঁর হস্তশিল্পপণ্যের মধ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা কমিক চরিত্র। দেশীয় জনপ্রিয় রূপকথার চরিত্র টোনাটুনি থেকে শুরু করে সুপার হিরো সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, বারবি ডল, সিনড্রেলা আর কত কিছুর কস্টিউম, কেপ, বিভিন্ন প্রাণীর আদলে তৈরি মুখোশ, হুড, হ্যান্ড পাপেট, ফিংগার পাপেট, মোমের তৈরি নানা কিছু। নাজনীনের হস্তশিল্প এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। স্থানীয় বাজারে খুচরা ক্রেতা ছাড়াও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলেও তাঁর পণ্যের কদর রয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি), অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও দি আগা খান স্কুল অন্যতম। তবে এই সফলতার সঙ্গে পিছু হেঁটে বেড়ানো বেদনার গল্পও রয়েছে।

১৯৯৪ সালে একটি ঘটনা থেকে পণ্য বাণিজ্যিকীকরণের প্রথম তাগিদ অনুভব করলেন নাজনীন আনসারী। ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে মরিশাস থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন একজন বিদেশি। তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে এসে ওই বিদেশি মোমের ওপর নাজনীনের তৈরি গ্রামের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি এমন চার হাজার পিস তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি আকর্ষণীয় হলেও মোমের ওপর নকশা করতে পারে—এমন কোনো সহকর্মী না পেয়ে তিনি তা নিতে পারেননি। কারণ, চার হাজার পিস একা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের কস্টিউম পরেছে স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের কস্টিউম পরেছে স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

এরপরের ঘটনাটি নাজনীনকে আজকের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে এনজিওর এক নারী কর্মকর্তার মাধ্যমে একজন ইউরোপীয় নারী স্কানস স্কলসির সঙ্গে পরিচয় হয়। স্বামীর চাকরিসূত্রে ওই নারী বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি পাপেট, কস্টিউমের কাজ জানতেন এবং এমন কাউকে খুঁজছিলেন, যাঁদের তা শেখাতে পারবেন। নাজনীন ও তাঁর আরেক বন্ধু স্কলসির কাছে তা শেখেন। তবে বন্ধুটি বিয়ের পর কানাডায় চলে যাওয়ায় নাজনীন একাই কিছু করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এনজিওর মাধ্যমে হস্তশিল্পের বিস্তার করতে চাইলেও নানান প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে এককভাবেই কাজটি শুরু করেন। স্কলসি তাঁর গুলশানের বাসায় তাঁকে জায়গা দিলেন কারখানা করার জন্য। সেখানেই গড়ে তোলেন সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটস। নিজে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলেন কর্মী বাহিনী।

নাজনীনের পণ্য প্রথমবার বিদেশে যাওয়া শুরু করে স্কলসির মাধ্যমে। স্কলসি নিজ দেশে যাওয়ার সময় নাজনীনের পণ্য নিয়ে যেতেন। বিদেশিরা সেসব এতই পছন্দ করেন যে রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেন নাজনীন।

১৯৯৯ সালে ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল্লাহকে বিয়ে করেন নাজনীন। কাজের ক্ষেত্রে স্বামীরও সহায়তা পাওয়া শুরু হয়। নাজনীন বলেন, ‘আমার কাজের ক্ষেত্রে সংসার বা পরিবার থেকে কখনো বাধা পাইনি; বরং উৎসাহই পাই। একমাত্র মেয়ে আরিসা বসুন্ধরার প্লে পেন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সদস্য হয়েছি ২০০২ সালে। চেম্বারের মাধ্যমে ভুটান ও নেপালে মেলায় অংশ নিয়েছি আমার পণ্য নিয়ে। সাড়াও পেয়েছি ব্যাপক।’

নাজনীন বলেন, ‘দেশি কাপড় ও উপকরণ দিয়ে পণ্য তৈরি করি। ইসলামপুর থেকে নিজে কাপড় কিনি। একদম ছোট শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পুতুলগুলোতে পুঁতি রাখি না। চোখের জায়গায় পুঁতির পরিবর্তে এমব্রয়ডারি করে দিই।’

নাজনীন জানান, ফিংগার পাপেটের পাঁচটির এক সেট বিক্রি করেন ২৫০ টাকায়। হ্যান্ড পাপেট ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা, মুখোশ ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কমিক চরিত্র অনুসারে কেপ কস্টিউমের জন্য ৫০০ টাকা এবং আপাদমস্তক ঢাকা কস্টিউমের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা দাম রাখা হয়।

রপ্তানির জন্য ফিংগার ও হ্যান্ড পাপেট, মুখোশ ও কস্টিউম মিলিয়ে একেকটি প্যাকেজ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে মাসে ৬০ হাজার থেকে লাখের ওপর তাঁর আয় হয়। রাজধানী ঢাকার মগবাজারে নিজের কারখানায় তৈরি হয় এসব পণ্য।

তবে এই পথচলায় নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়েছে বলে জানালেন নাজনীন। সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই জের এখনো টানতে হচ্ছে। ওই হামলার কারণে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের মুখোশ পরেছে রাজধানীর বসুন্ধরায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার (আইএসডি) শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের মুখোশ পরেছে রাজধানীর বসুন্ধরায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার (আইএসডি) শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

নাজনীন বলেন, ‘হোলি আর্টিজানে হামলার আগে আমার কারখানায় ৪০ জন কাজ করতেন। রপ্তানির অর্ডার ছিল অনেক বেশি। এখন সেটি অনেক কমে গেছে। ওয়ার্ল্ড ফেয়ার ট্রেডের মেম্বার হিসেবে আমি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস, অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনে প্রতি দুই মাস অন্তর আয়োজিত মেলায় অংশ নিতে পারতাম। ব্রিটিশ হাইকমিশন ও কানাডা হাইকমিশনেও নিয়মিত মেলা হতো। হোলি আর্টিজানে হামলার পর সেসব সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

নাজনীন বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে তাঁকে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোর মেলায় বিক্রি করে তাঁরা বেশি আয় করার সুযোগ পেতেন। সেখানে দু-তিন ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হতো।

নাজনীন বলেন, ‘সেই কাজগুলো কমে যাওয়ায় কারখানার কর্মী সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। এখন কয়েকজন কর্মী কাজ করেন।’

নাজনীনের কারখানার কয়েক কর্মীর একজন গারো সম্প্রদায়ের বিজয়া মানখিন। ২০০২ সাল থেকে তিনি সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসে কাজ করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আগের চেয়ে কাজ কমে যাওয়ায় কারখানায় কর্মী কমে গেছে। এখন তাঁরা পাঁচজন কাজ করছেন। প্রতিটি পণ্য হিসেবে তাঁরা মজুরি পান। একেকটি পাপেট আকৃতি অনুসারে ২৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত পান তাঁরা। আর কস্টিউমের জন্য প্রতিটি তৈরিতে পান ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে।

বিজয়া জানান, সব মিলিয়ে মাসে ছয়-সাত হাজার টাকা আয় হয়। আগে ১৪-১৫ হাজার টাকা আয় হতো বলে তিনি জানান। রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁদপুরে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন। মেয়ে কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করছেন।

নাজনীন জানান, এ বছর দুই হাজার পিস মুখোশের ফরমাশ পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিংগা ফেয়ার ট্রেড ইমপোর্টস নামক এক প্রতিষ্ঠান থেকে। এ মাসেই সরবরাহ করতে হবে। এ বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার সিহাম ক্র্যাফটস ৮০ হাজার টাকার পণ্য নিয়েছে। মেলবোর্নের পাইকারি পণ্য বিক্রির ওই প্রতিষ্ঠান স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রজাপতির শূককীট থেকে পূর্ণ প্রজাপতি হওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়া কাপড়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার ফরমাশ দিয়েছিল।

নেদারল্যান্ডসে আরটুক নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ বছরের বড়দিন উপলক্ষে হ্যান্ড পাপেটের ফরমাশ দিয়েছে। ওই দেশের হ্যাংগিং হাউস নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুই লাখ পিস পণ্য ফরমাশের বিষয়ে কথাবার্তা চলছে।

সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের কারখানায় কাজ করছেন কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত
সূর্যমুখী হ্যান্ডিক্র্যাফটসের কারখানায় কাজ করছেন কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত