ঈদে ছুটি কম বলে একটু আগেই কর্মব্যস্ততা শুরু

ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে অফিসে কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন দুজন। বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো
ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষে অফিসে কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন দুজন। বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বকাপ ফুটবল বাদ দিলে এবার ঈদুল ফিতর ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা বোধ হয় হয়েছে ‘ঈদের ছুটি’ নিয়ে। এ আলোচনায় আফসোস আর হতাশাই ছিল বেশি। দেখা যাচ্ছে, ট্রেন, বাস বা লঞ্চে করে বাড়ি ফিরে একটু দম ফেলতে না ফেলতেই ছুটি ফুঁ। আপনজনদের সঙ্গে বসে প্রাণ খুলে কথা বলার আগেই শুরু হয়েছে ঢাকায় ফেরার তোড়জোড়।

কোন কোন ঈদে এবারের মতো ছুটি কম ছিল, এ নিয়েও স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন অনেকে। এখন পর্যন্ত এ দেশে ঈদে শিকড়ের টানে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার আগ্রহই থাকে বেশি মানুষের। তবে এবার ছুটি কম থাকায় রাজধানী থেকে দূরের জেলাগুলোয় যাঁদের বাড়ি, তাঁদের অনেকে বাড়ি যাননি। কেউ কেউ ঢাকায় পরিবার ছাড়া একাই ঈদ করেছেন।

এবার ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপিত হয়েছে শনিবার। ঈদে সরকারি ছুটি থাকে তিন দিন। সে হিসাবে আগের দিন শুক্রবার এবং পরদিন গতকাল রোববার ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে। আজ থেকেই সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা শুরু হয়েছে। এই হিসাবই বলে দেয়, এই ছুটি নিয়ে কেন আফসোস থাকবে না! কারণ, শুক্র ও শনিবার তো সাপ্তাহিক ছুটি! তার মানে শুধু রোববারই ছুটি জুটেছে ভাগ্যে। চাকরিজীবীরা সাধারণত সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়েই ঈদ হলে বেশি খুশি হন। এতে করে সপ্তাহের শুরু ও শেষের দুদিন দুদিন করে চার দিনের সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ঈদের তিন দিন ছুটি মিলিয়ে সপ্তাহজুড়েই ছুটি পাওয়া যায়।

তবে চাঁদ তো চাকরিজীবীদের দিনক্ষণ মিলিয়ে দেখা দেয় না, চাঁদ তার নিয়মেই হাজির হয় ঈদের বার্তা নিয়ে। কখনো চাঁদের সঙ্গে চাকরিজীবীদের হিসাব মিলে যায়, কখনো মেলে না। যেমন এবার মেলেনি। তবে ঈদের এমন ‘সংক্ষিপ্ত’ ছুটি যে শুধু এবারই হয়েছে তা নয়, নিকট অতীতেও ঈদে এমন কম ছুটি কপালে জুটেছে শহরের ব্যস্ত মানুষদের। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে ঈদের ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

রাজধানীর রাস্তাঘাট ঘুরে দেখা গেছে, আজ থেকে অফিস খোলা শুরু হলেও রাজপথ এখনো চিরচেনা ব্যস্ত রূপ ধারণ করেনি। তবে কম ছুটির কারণে ঢাকার বাইরে যাওয়া লোকজন দ্রুত ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই নগরজীবনও দুই-এক দিনের মধ্যে আগের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায় বেশির ভাগ কর্মীকে আজ সকালে যথাসময়ে অফিস করতে দেখা গেছে।

মতিঝিলে সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কার্ড বিভাগের প্রধান আব্দুস সবুর খান প্রথম আলোকে বলেন, আজ ৮০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস করছেন। ২০ শতাংশ কর্মী অর্জিত ছুটি থেকে দুদিন বাড়তি ছুটি নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এবার ঈদের ছুটি অনেক কম পেয়েছি। আমরা আসলে শুধু রোববার এক দিন ছুটি পেয়েছি। ঈদের তিন দিনের মধ্যে দুদিন সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে পড়েছে। ব্যাংকে সাধারণত পাঁচ দিনের বেশি ছুটি দেওয়া হয় না। এ কারণে যাঁরা বাড়তি ছুটি নিয়েছেন, তাঁরা দুদিনের বেশি নিতে পারেননি। সোম ও মঙ্গলবার দুদিন ছুটি নেওয়ার পর কেউ যদি ভাবেন বুধ ও বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার যোগ করতে পারবেন, সে সুযোগও নেই। কারণ, তা হলে এই সাপ্তাহিক ছুটি তাঁর অর্জিত ছুটি হিসেবে কাটা যাবে। তাই এই ছুটির ব্যাপারে কেউ আগ্রহ দেখাননি।’

ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে গতকাল রোববার। আজ সোমবার থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো খুলেছে। তবে রাজপথ এখনো ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শাহবাগ, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো
ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে গতকাল রোববার। আজ সোমবার থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলো খুলেছে। তবে রাজপথ এখনো ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। শাহবাগ, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো

আব্দুস সবুর খান বলেন, ছুটি কম হওয়ার তাঁর অনেক সহকর্মী এবার বাড়ি যাননি।

সাউথ ইস্ট ব্যাংকের কার্ড বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা লায়লা পারভীন প্রথম আলোকে জানান, ঈদের ছুটি কম পাওয়ায় তিনি এবার বাড়ি যাননি। তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী ও ছেলে গ্রামের বাড়ি গেছেন। তিনি ঢাকায় একাই ঈদ করেছেন।

লায়লা পারভীন বলেন, ‘আমার বাড়ি বরগুনা। এত দূরে যেতে-আসতেই “চার দিন” লাগে! এত কম ছুটি পাওয়ার কারণে বাড়ি যাইনি। একাই এখানে ঈদ করেছি।’

কারওয়ান বাজারে প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স ভবনের নিরাপত্তাকর্মী সিরাজুল ইসলামও আফসোসের সুরে একই মন্তব্য করলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রতিবছর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে নিজ বাড়িতে ঈদ করি। এবার মাত্র এক দিনের ছুটি পাইলাম। এই দিয়া এত দূর যাওয়া পোষায়! ঢাকাতেই স্ত্রী-সন্তান নিয়া ঈদ করছি। বাসার সবাই খুব মন খারাপ করছে।’

গত পাঁচ বছরের ঈদের ছুটি
এদিকে গত পাঁচ বছরের ঈদের ছুটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরে নয় দিনের লম্বা ছুটি পেয়েছিলেন চাকরিজীবীরা। ২০১৪ সালের ২৯ জুলাই মঙ্গলবার দেশে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপিত হয়। সেবার সরকারি ঘোষণা না থাকলেও শবে কদর, সাপ্তাহিক ছুটি ও আগাম ছুটি মিলিয়ে নয় দিনের ছুটি কাটাতে দেখা গেছে চাকরিজীবীদের।

২০১৫ সালেও এবারে মতো সংক্ষিপ্ত ঈদুল ফিতরের ছুটির ফাঁদে পড়েছিলেন চাকরিজীবীরা। সে বছর ১৮ জুলাই শনিবার ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপিত হয়। এর অর্থ ওইবারও এবারের সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ‘কাটাকুটি’ হয়েছিল ঈদের ছুটি।

২০১৬ সালে কাঙ্ক্ষিত ঈদের ছুটির ফাঁদে ছিল দেশ। ওই বছর ঈদুল ফিতরের আগে চাকরিজীবীদের শেষ অফিস ছিল ৩০ জুন। ১ ও ২ জুলাই ছিল (শুক্র ও শনিবার) সাপ্তাহিক ছুটি। ৩ জুলাই ছিল শবে কদরের ছুটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাহী ক্ষমতাবলে ৪ জুলাই সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। তবে শর্ত ছিল, ৪ জুলাইয়ের পরিবর্তে ১৬ জুলাই (শনিবার) অফিস করতে হবে। ৫, ৬, ৭ জুলাই ঈদের তিন দিনের ছুটির ঠিক পরপরই আবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ওই ঈদুল ফিতরে চাকরিজীবীরা নয় দিনের ছুটি পেয়েছিলেন।

ওই বছর প্রধানমন্ত্রীর আদেশে ঈদুল আজহাতেও ছয় দিনের লম্বা ছুটি পেয়েছিলেন চাকরিজীবীরা। ওই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ছিল ঈদুল আজহা। সে অনুযায়ী ১২, ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ছিল সরকারি ছুটি। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতাবলে ১১ সেপ্টেম্বরও (রোববার) ছুটি যোগ করা হয়। তবে ১১ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে ২৪ সেপ্টেম্বর শনিবার অফিস করার নির্দেশনা ছিল। ১১ সেপ্টেম্বরের আগের দুদিন শুক্র ও শনিবার থাকায় ওই ছুটি ছয় দিনে গিয়ে দাঁড়ায়।

২০১৭ সালের ২৬ জুন সোমবার ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপিত হয়। এর আগের রোববার থেকে ঈদের ছুটি শুরু হলেও এর আগের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি মিলে যাওয়ায় গেলবার চাকরিজীবীরা ঈদের ছুটি পেয়েছিলেন পাঁচ দিন।

সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লেনদেন শুরু। মতিঝিল, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো
সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লেনদেন শুরু। মতিঝিল, ঢাকা, ১৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো

ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঈদুল আজহার দিনটি ছিল শনিবার। সেবারও কম ছুটি পেয়েছিলেন চাকরিজীবীরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই ঈদের ছুটি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এর আগে ২০১০ সালেও একবার ঈদের ছুটি পাঁচ দিন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু পরে তা নাকচ হয়ে যায়। গত বছর ঈদুল আজহার আগে ঈদে সরকারি ছুটি ছয় দিন করাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে ছুটি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রস্তাব নিয়ে আবারও আলোচনা হয়। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া যায়নি।

ওই প্রস্তাবে নৈমিত্তিক ছুটি বিদ্যমান ২০ দিন থেকে কমিয়ে ১৪ দিন করে বাকি ছয় দিন দুই ঈদের ছুটির সঙ্গে তিন দিন করে সমন্বয় করার সুপারিশ করা হয়। তবে সে ক্ষেত্রে ঈদের সঙ্গে ঐচ্ছিক ছুটি বাতিল হবে। এ ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের সরকারি ছুটির সঙ্গে দুদিন করে চার দিন ঐচ্ছিক ছুটির প্রস্তাব করা হয়। এতে আরও বলা হয়, পবিত্র ঈদে ছুটি বাড়ানো হলে মোট ছুটির সময় ঠিক থাকবে। ফলে সরকারি কার্যক্রমের জন্য সময় কমবে না।