ভোটার হারাতে চান না আ.লীগ ও বিএনপির প্রার্থী

জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার
জাহাঙ্গীর আলম ও হাসান উদ্দিন সরকার

দড়িতে বাঁধা পোস্টারগুলোর এক প্রান্ত ছিঁড়ে বিদ্যুতের লম্বা খুঁটিটির গায়ে ঝুলছে। সাদা-কালো রঙের পোস্টারগুলো ল্যামিনেটিং করা। তারপরও এমনভাবে মুচড়ে গেছে যে বোঝা মুশকিল এগুলো কোন প্রার্থীর ছিল। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল এক মাস আগে। তারও আগে নিশ্চয়ই এগুলো লাগানো হয়েছিল। মাঝে এগুলোর ওপর দিয়ে গেছে ঝড়-বাদল। তাতেই এই হাল। টঙ্গীর ভরন এলাকায় এমন দৃশ্য আরও চোখে পড়ল। এলাকাটির দুপাশজুড়ে বহুতল বাড়িঘর। রাস্তার পোস্টারের হাল–হকিকত খারাপ হলেও বাড়িগুলোর ছাদে বা বিভিন্ন তলায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানিসহ কয়েক দেশের পতাকাগুলো কিন্তু এখনো সতেজ। বিশ্ব কাঁপানো বিশ্বকাপ ভর করেছে ঢাকার পাশের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এই এলাকায়, স্বাভাবিকভাবেই।

দেশের সবচেয়ে বড় এ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ২৬ জুন। হওয়ার কথা ছিল ১৫ মে, খুলনার সঙ্গে। তবে আইনি জটিলতায় তা পিছিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, ঈদের পরই হবে। মাঝে এক মাসের বেশি সময় নির্বাচনী প্রচার বন্ধ ছিল। আজ সোমবার আবার প্রচার শুরু হচ্ছে। গত শনিবার ঈদের দিন সেখানে গিয়েছিলাম প্রধান দুই প্রার্থীর ঈদের দিন কাটানোর খবর করতে। দুই প্রার্থী বলতে বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার আর আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম। বিশ্ব লড়াইয়ের মধ্যেই তাঁদের নামতে হচ্ছে নিজস্ব বা দলগত লড়াইয়ে। কিন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারের নানা কথা বললেও একটি ব্যাপারে দুজনের কিন্তু মুখে কুলুপ।

ঈদের প্রায় সারাটি দিন থাকলাম দুজনের সঙ্গে। নির্বাচন নিয়েই কথা হলো বেশি। এর পাশাপাশি রমজান মাস কেমন কাটল, ঈদের কেনাকাটা, ঈদের পাঞ্জাবি কেনা হলো কি না, ঈদের দিনের খাবারদাবার—বাদ গেল না কিছুই। সবকিছুতেই তাঁরা চটপট উত্তর দিলেন। চলমান বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা আসাটা খুবই সংগত। এলও। উত্তর শুনুন হাসান সরকারের, ‘আমি আগে খেলা দেখি। তারপর যে দল ভালো খেলে, তারে সাপোর্ট করি। ও রকম প্রিয় দল নেই।’

৭১ বছর বয়সী হাসান সরকাররে উত্তরের সঙ্গে মিলে যায় চল্লিশে পা দেওয়া জাহাঙ্গীর আলমের কথা। বললেন, ‘খেলা দেখার পর সিদ্ধান্ত নিই। প্রিয় দল নেই ভাই। তবে যারা হারে, তাদের প্রতি একটা সহানুভূতি তৈরি হয়।’

এসব উত্তরের মানে কী, দুজন কি ক্রীড়া–সচেতন নন? বঙ্গদেশে এমন মানুষ কজন আছে, যার বিশ্বকাপে দল নেই। ছোটবেলায় ফুটবল না হোক জাম্বুরায় লাথি না দেওয়া বঙ্গসন্তানও তো মেলা ভার।

গাজীপুর সিটির প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীরও খেলাধুলার অভিজ্ঞতা আছে। এর মধ্যে হাসান সরকার একেবারে ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেছেন। প্রথমে ফায়ার সার্ভিস দলের হয়ে খেলেন। পরে রেলওয়ের ডাক পেয়ে সেই দলে খেলেন। তারুণ্যের সেই দিনগুলোর স্মরণ করেন সাদা-দাঁড়ি এবং চুলে ঢেকে থাকে গাজীপুরের অভিজ্ঞ রাজনীতিক হাসান সরকার। বলেন, ‘প্রচুর খেলছি একসময়। মাতোয়ারা ছিলাম। পরে রাজনীতিতে এসে বাদ গেছে। তবে খেলাধুলার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকেছি সব সময়। এখনো খেলা দেখি।’

হাসান সরকারের মতো বড় ফুটবলার জাহাঙ্গীর ছিলেন না। তবে নিজ গ্রাম জয়দেবপুরের কানাইয়ার প্রান্তর, গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের মাঠে ফুটবল খেলার সুখস্মৃতি স্মরণ করেন নিমেষেই। বিশ্বকাপের কথা উঠতেই বোঝা গেল, এ বিষয়ে ভালো খোঁজ-খবর রাখেন।
এহেন দুই ক্রীড়াপ্রেমীর প্রিয় দল থাকবে না কেন? দলের কথা জিজ্ঞেস করলে অমন প্রহেলিকায় ভরা উত্তরের কারণ কী?

জাহাঙ্গীর আলমের বসার ঘরে প্রিয় দল নিয়ে কথা বলতে যখন পিচ্ছিল সব উত্তর পাচ্ছি, তখন তাঁর দলের এক নেতাই সহাস্যে বলে ফেললেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রিয় দলের কথা বইল্যা ভাইয়ে (জাহাঙ্গীর আলম) কি বিপদে পড়ব নাকি? হয়তো কইল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার লোকেরা খেইপ্যা গেল। সে জন্যে ভাইয়ে চুপ।’

সহকর্মীর কথায় সমর্থন মেলে নেতার। দলের বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ এক নেতাকে ডিঙিয়ে মনোনয়ন পাওয়া, মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো করে ফেলা জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে যে এই ভয় আছে, তা স্পষ্ট হলো। বললেন, ‘ভাই, ২৬ তারিখ জেতার পর প্রিয় দলের কথা বলে দিব, যান।’

টঙ্গী পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান, এ তল্লাটের সব আন্দোলন-নির্বাচনে প্রথম সারিতে থাকা হাসান সরকারও কী সমর্থন হারানোর ভয়ে ফুটবলের প্রিয় দলের কথা বলতে নারাজ? প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন হাসান সরকার। বলেন, ‘না ভাই, তা না। এখন আর কোনো দলের প্রতি আগ্রহ নাই। কারও কারও খেলা ভালো লাগে, এই আরকি।’

বুঝলাম, তাঁদের ‘ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি’ দেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। অন্তত নির্বাচনের আগে!