সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে যুক্তিতর্ক অব্যাহত

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার আসামি সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষে যুক্তিতর্ক অব্যাহত আছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাকি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নুরউদ্দীন।

এই তিন আসামি হলেন সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির রুহুল আমীন, আবদুর রশিদ ও মুন্সী আতিকুর রহমান। তাঁদের পক্ষে আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তিনি মামলার এজাহার, প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগপত্রের আলোকে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন।

জজ মিয়ার নাটক সাজিয়ে মামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ও তদন্তে অবহেলার অভিযোগে এই তিনজনকে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়।

এখন পর্যন্ত এ মামলায় ৩৮ আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। তিনজনের পক্ষে অব্যাহত আছে। আর চার আসামির যুক্তিতর্ক উপস্থাপন বাকি রয়েছে। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে এরপর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করবেন আদালত।

আসামিপক্ষের শুনানি শুরুর আগে রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান, বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন ও আসামিপক্ষে আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদারসহ অন্য আইনজীবীরা বিচারকের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। তাঁদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর থেকেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করে। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই তাজউদ্দিন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এ-সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দেন, যাঁরা জোট সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন।

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপি নেতা তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টু, শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদসহ ৫২ জন আসামির মধ্যে ৪১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধসহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, কর্তব্যকাজে অবহেলার অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আর এ মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন উদ্দিন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, সাবেক সুপার ওবায়দুর রহমান খানসহ তদন্ত কর্মকর্তা রহুল আমীন, আবদুর রশিদ ও মুন্সী আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্ট ও কর্তব্যকাজে অবহেলা করার অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি। অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯।

আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ১১ জনকে মামলার অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৩৮।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এ মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ছয়জন কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টুসহ ২৩ জন আসামি কারাগারে আছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজনকে হত্যার মামলায় হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাঁদের এই মামলার আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। জামিনে আটজন এবং কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন।