নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ অর্থনৈতিক দিগন্তে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে

নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক দিগন্তে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই উচিত সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তর করা।

আজ বুধবার ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অবচ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ফিকি) এক অনুষ্ঠানে কীভাবে দুই দেশ তা করতে পারে, সে আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নেন দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা। 
চলতি বছরের ১৫ মার্চ জাতিসংঘের ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি’ (সিডিপি) ঘোষণা করে, বাংলাদেশ এখন আর নিম্ন আয়ের দেশ নয়। আলোচনার শুরুতে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তা উল্লেখ করে বলেন, মধ্য আয়ের ধাপে উঠতে গেলে তিন ক্ষেত্রের মধ্যে অন্তত দুটিতে উন্নয়ন প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ তিন ক্ষেত্রেই এগিয়ে গেছে। এই উত্তরণ খুলে দিয়েছে এক বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই উচিত সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।
বাংলাদেশ কীভাবে টেকসই উন্নয়নের দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে, আগামী দিনে দেশটির লক্ষ্য কী, তা ব্যাখ্যা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের টেকসই উন্নয়নসংক্রান্ত বিভাগের প্রধান কোঅর্ডিনেটর মহম্মদ আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, এই লক্ষ্যে মোট ১০টি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সেন্টার ফর রিজিওনাল ট্রেডের প্রধান অধ্যাপক রাম উপেন্দ্র দাস টেকসই উন্নয়নের সুর ধরে বলেন, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের বেশিটাই ভারতের অনুকূলে। এটাই চিন্তার। বাণিজ্যিক সম্পর্কের এই ঘাটতি কী করে কমানো যায়, সেদিকে দুই দেশকেই মনোযোগী হতে হবে। সচেষ্ট হতে হবে শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো দূর করার।

উপেন্দ্র দাস বলেন, শান্তি অবশ্যই সমৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক। কিন্তু সমৃদ্ধিও যে শান্তি ডেকে আনে, তা বোঝা দরকার। শান্তির জন্য বসে না থেকে সমৃদ্ধির দিকে এগোনো উচিত। 
জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশের মোট জাতীয় আয়ের মাথাপিছু হিসাব ১ হাজার ২৩০ ডলারের বেশি হলে সেই দেশ নিম্ন আয়ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে না। ২০১৬-১৭ সালের আর্থিক বছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৬১০ ডলার। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া মানবসম্পদ সূচকের হার হওয়া উচিত ন্যূনতম ৬৬। সেখানে ওই অর্থবছরে বাংলাদেশের মানবসম্পদ সূচক দাঁড়ায় ৭২ দশমিক ৮। অর্থনৈতিক দুর্বলতার সীমারেখা চিহ্নিত ছিল ৩২ অথবা এর কম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮। বাংলাদেশ যদি ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই অগ্রগতি ধরে রাখতে পারে, তা হলেই দেশটি পাকাপাকিভাবে নিম্ন আয়ের তকমা ঝেড়ে ফেলে মধ্য আয়ভুক্ত দেশ হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জানান, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ কীভাবে দ্রুত দারিদ্র্য দূরীকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে গ্রামে গ্রামে কৃষি ও অকৃষিকাজের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে ঠিকই, তবে জ্ঞান ও পানিভিত্তিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের উন্নয়নের দিকে এগোনোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দরকার আবহাওয়া পরিবর্তনে সহযোগিতাও।
বেসরকারি ডিএইচএল গোষ্ঠীর জ্যেষ্ঠ পরিচালক প্রীতম ব্যানার্জি যোগাযোগের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁর সুপারিশ, সীমান্ত চেকপোস্টগুলোর সংখ্যা ও অবকাঠামোর খোলনলচে বদলানো দরকার। না হলে সেগুলো শ্বাসরোধকারী হয়ে থাকবে। ব্যর্থ হবে যোগাযোগ বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বিনিয়োগের উজ্জ্বল সম্ভাবনার ছবি তুলে ধরেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম। তিনি বলেন, বাণিজ্য-ঘাটতি কমিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। 
একটা সময়ে যে দেশটাকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে তুলনা করা হতো, সেই দেশ আজ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, তৃতীয় বৃহত্তম ‘আউটসোর্সিং’ দেশ, চাল উৎপাদনে পৃথিবীতে চতুর্থ, মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, শ্রম রপ্তানিতেও বিশ্বে পঞ্চম, বিদেশি মুদ্রা আয়ের নিরিখে অষ্টম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে দশম। ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বাংলাদেশকে আজকাল প্রায়ই তুলনা করা হয়। ফিকির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল মনীশ সিংঘল এ কথা জানিয়ে বলেন, তাঁর আশা, ভারতের শিল্পোদ্যোক্তারা অবশ্যই এই অগ্রগতির সুযোগ নেবেন। উপকৃত হবে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ ও অর্থনীতি।