গাজীপুরে ভোটের 'পার্টি-গণিত'

কোনো এলাকার নির্বাচনের আগে চায়ের দোকানের আড্ডার আলোচ্য বিষয় সাধারণত থাকে ‘নির্বাচন’। টঙ্গীর এরশাদনগরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে চায়ের দোকানটিতে আলোচনার বিষয়ও তা-ই। দোকানিসহ সেই আলোচনায় অংশগ্রহণকারী চারজন। নিম্ন আয়ের মানুষ সবাই। তবে তাঁদের আলোচনায় উত্তাপ নেই। এ নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন। তবে আলোচনা আওয়ামী লীগ আর বিএনপির প্রার্থীদের ঘিরেই চলছে। দোকানি ইসমাইল শেখ একসময় পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। পরে এ দোকান করেছেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মানুষ, এ এলাকার আছেন ২২ বছর ধরে। নির্বাচনে জিতবেন কে—এমন প্রশ্নে খানিকটা গম্ভীর হয়ে যান। বললেন, ‘হিসাব জটিল। ধরুইন, হাসান সাহেব (বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার) এ এলাকার মানুষ। সেইডা একডা হিসাব। আবার নৌকার দলের ভোট আছে। সেইডাও আরাক হিসাব।’

দোকানে বসে থাকা রিকশাচালক হাসেম মিয়া অবশ্য মানতে নারাজ, এলাকার লোক হিসেবে হাসান সরকার বিশেষ কোনো সুবিধা পাবেন। হাসেমের কথা, ‘এহন ভোট অয় পার্টি দেইখ্যা। যে পার্টি ভালো করবো, তারাই জিতব।’

আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সবাই কিন্তু ‘ভালো ভোট’ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে। তাঁরা আরেকটি বিষয়ে একমত, এখানে নিশ্চিত করে বলে দেওয়ার উপায় নেই কে জিতবেন। এসব মানুষের আলাপচারিতার সারাংশ হলো: এ ভোটে পরিবার, আঞ্চলিকতা, প্রশাসন—এসব নানা বিষয় কাজ করবে। আর এবার ‘মার্কার’ ভোট হওয়ায় বিষয়টি জটিল হয়ে গেছে বলেও মনে করেন তাঁরা।

যদিও প্রধান দুই দলের দাবি, নির্বাচনে জিতবে তারাই। গাজীপুরের আগের নির্বাচনগুলোর হিসাব নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেন দুই দলের নেতারা।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গাজীপুরের সব সংসদীয় আসনে দীর্ঘ সময় ধরে জিতছেন। এবার সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে।

আর বিএনপির নেতারা বলছেন, এখানে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট বিভক্ত হয়েছে বলেই বারবার তারা জিতেছে। এই ভোট এক হলে তাদের জেতা সহজ হতো না। গত সিটি করপোরেশনের ভোট তার প্রমাণ।

জাতীয় সংসদের গাজীপুর-১, ২ ও ৩ আসনের কিছু কিছু অংশ নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা গঠিত। সিটি করপোরেশনের মোট ওয়ার্ড ৫৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি ওয়ার্ড পড়েছে গাজীপুর-২ আসনে। ১৮টি আসন আছে গাজীপুর-১ আসনের মধ্যে। আর গাজীপুর-৩ আসনে রয়েছে চারটি ওয়ার্ড। ৭ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি ভোট গাজীপুর-২ আসনের ৩৫ ওয়ার্ডে। গাজীপুর-২ আসনের ১৮টি ওয়ার্ডে আছে ৩ লাখ ২৩ হাজারের বেশি ভোট। আর গাজীপুর-৩ আসনের চার ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৬০ হাজার ৮৮৬।

তিনটি আসনই দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির প্রার্থীদের হাতছাড়া। গাজীপুর-১-এ তো বিএনপি সেই ১৯৯১ সাল থেকে একবারও জিততে পারেনি। সেখানে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রহমত আলী বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনের পুনর্বিন্যাসে গাজীপুর-১ আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আ ক ম মোজাম্মেল হক।

১৯৯১ সালে একবারই আবদুল মান্নান গাজীপুর-২ আসনে বিএনপির হয়ে জিতেছিলেন। তারপর থেকেই ওই আসনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বেশি ভোটার আছে এই আসনে। এ আসনের হিসাব-নিকাশ কিন্তু বেশ জটিল। এখানে নির্বাচন কখনো দ্বিমুখী, কখনো ত্রিমুখী এমনকি চতুর্মুখী হয়েছে। আর তাই এখানকার ভোটের হিসাবও জটিল। ১৯৯১ সালে এ আসনে পরাজিত হন গাজীপুর-১-এর সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল। সেই নির্বাচনে পরাজয় প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সময় জাতীয় পার্টির ভোট বিএনপিতে গিয়ে পড়েছিল। তাই এমন ফল হয়।’

১৯৯৬ সালে গাজীপুর-২ আসনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আহসান উল্লাহ মাস্টার। নির্বাচনে দ্বিতীয় হন বিএনপির আবদুল মান্নান।

বিএনপির গাজীপুর জেলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির হয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন এবারের সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। মান্নান সাহেব ও হাসান সরকারে ভোট এক হলে আওয়ামী লীগ হেরে যেত।’

১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন হাসান সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান। তবে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন আবদুল মান্নান। নির্বাচনে দ্বিতীয় হন তিনি। বিএনপির হাসান সরকার হন তৃতীয়। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চতুর্থ হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। আওয়ামী লীগ ওই ভোটে যে ভোট পায়, হাসান সরকার ও আবদুল মান্নানের সম্মিলিত ভোট কিন্তু তার চেয়ে কিছু বেশি।

২০০১ সাল পর্যন্ত গাজীপুর-২-এ আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের এই ‘বিভাজন’ থাকলেও ২০০৮-এর নির্বাচনে কিন্তু তা ছিল না। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার হেরে যান হত্যাকাণ্ডের শিকার আওয়ামী লীগের সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ হাসান রাসেলের কাছে।

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন সরকার কিন্তু মনে করেন, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একই রকম হয়েছিল। তাঁর কথা, ‘২০০৮ সালে দেশের সমস্ত গণমাধ্যম আমাদের বিপক্ষে ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল আমাদের বিপক্ষে। আমরা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করেছি। তাই ফলাফল এমন হয়েছিল।’

তবে আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম মোজাম্মেল মনে করেন, আওয়ামী লীগের বিরোধী ভোট এক হলেও নৌকা যে অপ্রতিরোধ্য, ২০০৮ সালেই তা প্রমাণিত হয়েছে। আ ক ম মোজাম্মেল বলেন, ‘গাজীপুরের মানুষ সব সময় আওয়ামী লীগকেই বেছে নিয়েছে।’

আ ক ম মোজাম্মেল যেটা বলছিলেন, ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুর গত কয়েকটি নির্বাচনে তাদের বেশির ভাগ আসন উপহার দিয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপির ভূমিধস বিজয়ে তিনটি আসনেই জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

গাজীপুরের চার আসনে দীর্ঘদিন ধরে আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, এটি তাঁদের প্লাস পয়েন্ট।

দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে ‘ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরূপ’ মনোভাবও কি হতে পারে না?

আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার
আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার

বিএনপির ভাবনা গাজীপুরে তারই বহিঃপ্রকাশ হবে। তবে আওয়ামী লীগের কথা, এখন শাসক দল আওয়ামী লীগ হলেও গাজীপুরে সিটিতে তারা ছিল না, ছিল বিএনপি। গত পাঁচ বছরে এ সিটিতে কোনো কাজ হয়নি। এখানে জনগণ ‘শাসকের প্রতি বিরূপ’ হলে তা তাদের পক্ষে যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি গাজীপুরের কয়েকটি ওয়ার্ডে সংগঠনটির নির্বাচনকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান করেছেন। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে আছে, এটা তাদের জন্য ভালো এবং মন্দ উভয়ই হতে পারে।’

বদিউল আলম মনে করেন, এ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের বাইরে পরিবারের বিষয়টিও একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। সব মিলিয়ে গাজীপুরের নির্বাচনের জটিল সমীকরণ আছে।