গাজীপুরে আ.লীগ-বিএনপির 'খুলনা কৌশল'

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা গাজীপুরে কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমতাসীন দলটি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজেদের নেওয়া কৌশলকে ব্যবহার করে জয় ছিনিয়ে আনতে চায়। অন্যদিকে বিএনপি চায়, খুলনায় সরকারি দলের কৌশলের কাছে পরাজিত হওয়ার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে।

গাজীপুর নির্বাচনের বাকি আর দুই দিন। এরই মধ্যে বিএনপিসহ রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে সরকারি দলের কৌশল নিয়ে। অনেকেই বলছেন খুলনা সিটি নির্বাচনে নেওয়া কৌশলকে ভিত্তি ধরে সরকারি দল গাজীপুরে ছক কষছে। এর সঙ্গে মানানসই পরিকল্পনা যোগ করে জয় ঘরে তুলতে চায় সরকারি দল।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারও অভিযোগ করেছেন, খুলনা সিটি নির্বাচনে যে কৌশল ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ জিতেছে, গাজীপুরেও তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খুলনায় যেভাবে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে-একইভাবে গাজীপুরেও অবাধ ভোট হবে। উন্নয়নের লক্ষ্যে ভোটাররা নৌকা প্রতীককেই বেছে নেবে।
অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খুলনার মতো ষড়যন্ত্রের ভোট গাজীপুরে হতে দেওয়া হবে না।

প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক ও মহাসচিব যাই বলুন না কেন, ভোটারদের ভেতর উৎসাহের পাশাপাশি আশঙ্কাও কম নয়।

সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভোটে জেতার বিষয়ে উৎসাহ থাকলেও আশঙ্কা কম নেই। ভোটের রাজনীতির নানা সমীকরণ বিশ্লেষণ চলছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। নীরব ভোট আর সরব ভোটের পাশাপাশি দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের তৎপরতা দলের বিজয়ে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটাও বিবেচনায় রয়েছে। কর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নীতি নির্ধারকেরা ছক কষছেন দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে। সে কারণে ঢাকা, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুরে দফায় দফায় বৈঠক করছেন নেতারা। কর্মীদের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানো কিংবা বিরোধ মেটানোর চেষ্টা প্রতিনিয়তই চলছে। পাশাপাশি চলছে ভোটের দিনের জন্য কর্মকৌশল তৈরির কাজ।

খুলনার নির্বাচনে প্রকাশ্যে তেমন বড় ধরনের কোনো সমস্যাই দেখা যায়নি। দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি। সরকারি দলের নির্বাচনী কৌশলের কাছে হার মানতে হয়েছে বিএনপিকে। তবে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল তাঁর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার। মাঠে বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। খোদ সরকারি দলের তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, ‘ভোটের দিন তাঁদের কর্মীরা ব্যাজ পরা ছিলেন। কিন্তু তিনি সারা দিন বিএনপির প্রতীকের ব্যাজধারী কাউকে কোনো কেন্দ্রে দেখেননি। তাঁর ভাষ্য, কোথাও কোনো ভোটারকে বাধা দেওয়া হয়নি। সবাই নীরবে ভোট দিয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘বাধা দিলে তাঁরা (বিএনপি) এত ভোট কীভাবে পেল?’

খুলনায় ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রেই ছিল সরকারি দলের একাধিক নির্বাচনী প্যান্ডেল। বিএনপি প্রার্থীর প্যান্ডেল খুব বেশি ছিল না। প্রত্যেক কেন্দ্রে স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকা থেকে আসা নেতাদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। প্রতিটি কেন্দ্রেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন একজন জ্যেষ্ঠ নেতা যিনি সবার মধ্যে সমন্বয় করেছেন। ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে নৌকা প্রতীকের স্টিকার লাগিয়ে চলাচল করেছেন।

গাজীপুরে নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন নেতা বলেছেন, নির্বাচন পেছানোর কারণে সরকারি দল বেশ লাভবান হয়েছে। জনসমর্থনের দিক থেকে এগিয়ে গেছে তারা। তারপরও তাদের শঙ্কা কাটেনি। স্থানীয় নেতা কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের। নেতারা নানা বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। যেসব জায়গায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে দূরত্ব আছে সেগুলো মিটমাট করে দেওয়া হচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচন ঘোষণার পরপরই দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানককে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রত্যেকটি থানা এলাকায় এক একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা প্রতিদিনই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্বাচনী প্রচার করছেন, তদারক করছেন।
খুলনা সিটি নির্বাচনে তালুকদার আবদুল খালেকের প্রধান সমন্বয়কারী এস এম কামাল হোসেন সম্প্রতি গাজীপুর ঘুরে গেছেন। আজকে পর্যন্ত সেখানে আছেন তালুকদার খালেক। সেখানে তিনি খুলনা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দিয়েছেন। ভোটের দিন ও তার আগে নির্বাচনী করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন।

কয়েক দিন আগে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ৪২৫ টি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য ৪২৫টি কমিটি করেছে যুবলীগ। গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেলের নেতৃত্বে গঠিত এসব কমিটি প্রতিদিনই নির্বাচনী প্রচার করছে কেন্দ্রভিত্তিক। ভোটের দিনও এ কমিটি এসব কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবে। এ কমিটির তত্ত্বাবধান করছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।
এর বাইরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আলাদা কমিটি হচ্ছে ভোটের দিন দায়িত্ব পালনের জন্য।

‘ভুল; শুধরে কৌশলী বিএনপি:

খুলনা সিটি নির্বাচনের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে গাজীপুরে বিজয় ছিনিয়ে আনতে চায় বিএনপি। এজন্য পরিকল্পনা সাজিয়েছে দলটি। বিএনপির নীতি নির্ধারকেরা বলছেন, খুলনায় ভোটের দিন কেন্দ্রগুলোতে কর্মীশূন্য থাকাটাই তাদের বড় ভুল। এ ছাড়া সেখানে কেন্দ্র এজেন্ট উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে পারেনি তারা। কর্মীস্বল্পতা আর এজেন্টদের অনুপস্থিতির কারণে খুলনায় ভোট কেন্দ্রে সরকারি দল ‘কারচুপি’ করতে পেরেছে।

এসব বিষয় মাথায় রেখে বিএনপির পরিকল্পনা হলো, মাঠে থাকা। ভোটের আগের রাতে কেন্দ্র পাহারা, ভোটের দিনে নেতা-কর্মীদের উপস্থিত রাখা, ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ভোটের দিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি বুথেই এজেন্ট উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় তারা। একই সঙ্গে মামলা নেই এমন নেতা-কর্মীদের পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আজ সকালে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার আবারও তাঁর নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তারের অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন,‘আমাদের এজেন্টদের আটকে রাখার চক্রান্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় আটকে রেখে তাঁদের কোনো কিছু করতে দেওয়া হবে না। তাঁদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির ৫০ জন নেতা কর্মীকে মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। আজ নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে ওই সব মামলায় নেতা কর্মীদের অনেকের হাজিরার দিন ধার্য করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে, যাতে নেতা কর্মীরা তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে না পারেন।

গাজীপুর ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নেতারা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা আর গাজীপুরের পরিবেশ এক না। এটা অনেক বড় সিটি করপোরেশন। এক প্রান্তে কিছু ঘটলে খবর পেলে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।

গাজীপুর বিএনপির সভাপতি ও হাসান উদ্দিন সরকারের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফজলুল হক মিলন বলেন ‘সরকারি দলের হাজারো চাপের ভেতরেও ভোটের শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীরা থাকবে। খুলনার মতো প্রহসনের চেষ্টা করা হলে গাজীপুরবাসী রুখে দাঁড়াবে।