হিসাব কষছে দুই দল, ভোটাররা চুপ

সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বরিশালে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে চলছে নানা সমীকরণ। বিগত দিনের ভোটের হিসাব কষে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী বিএনপি। যদিও ভোট সুষ্ঠু হবে কি না, সেটা নিয়েই তারা শঙ্কিত। আর সরকারের উন্নয়ন ও নতুন ভোটারদের সমর্থন—দুয়ে মিলে জয়ের ব্যাপারে প্রত্যয়ী আওয়ামী লীগ। তবে এখন পর্যন্ত ভোটাররা কেন যেন নিশ্চুপ, ভোট নিয়ে আগ্রহ-উদ্দীপনা কম।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ ৩০ জুলাই। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হবে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও বরিশালে এসে এমন আশ্বাস দিয়েছেন।

শহরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে এবার প্রভাবশালী দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একদিকে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, অন্যদিকে মজিবর রহমান সরোয়ার। সাদিক সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে। আর সরোয়ার আগে মেয়র ও সাংসদ ছিলেন। বরিশালের রাজনীতিতে তিনি বেশ প্রভাবশালী। তাই ভোটাররা কাকে বেছে নেবেন, সেই সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন।

একজন আইনজীবী বলেন, বিগত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ভোটাররা কোনোভাবেই সুষ্ঠু, স্বাভাবিক নির্বাচনের বিষয়ে আস্থা রাখতে পারছেন না। এ জন্য ভোট নিয়ে আগ্রহ কম। এখন ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনাই রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

খুলনা ও গাজীপুরের অভিজ্ঞতার পর বরিশালে বিএনপি কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে, জানতে চাইলে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দীন সিকদার বলেন, ‘নির্বাচনের পর এই সরকারের মেয়াদ থাকবে দুই থেকে সোয়া দুই মাস। বড় কথা হলো, মানুষ সব বুঝে গেছে। তারপরও আমরা ভোটারদের সচেতন করছি তাঁরা যাতে ভোটকেন্দ্র যান। আর আমাদের নেতা-কর্মীরা জীবন বাজি রেখে কেন্দ্রে থাকবেন।’

নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বরিশাল নগরের পরিবেশ এখন পর্যন্ত শান্ত। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর এই পরিবেশ বজায় থাকবে বলে সবাই আশাবাদী। এখন ভোট নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হবে বড় দুই দলের প্রার্থী। ভোট আর দলীয় রাজনীতির মাঠে সরোয়ার কখনো হারেননি। তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আবার বরিশালের প্রথম মেয়রও তিনি। দলীয় পদও দুটি—নগর বিএপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। তবে এবার মেয়র পদে মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে।

বিএনপির মাঝারি সারির এক নেতা আলাপকালে প্রশ্নও করেন, ‘সব নির্বাচনই যদি মজিবর রহমান সরোয়ার করবেন, তাহলে অন্যরা কী করবেন? অন্যরা কি কোনো সুযোগই পাবেন না?’ সরোয়ারের সমর্থক নেতারা বলছেন, এই নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাবের সামনে অন্য কারও টিকে থাকা কঠিন হবে। এখানে সরোয়ারকে প্রার্থী করা ঠিকই আছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমাদের কাছে এবারের নির্বাচনটা অন্যবারের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের চলমান সংগ্রামেরই অংশ। খুলনা, গাজীপুরের নির্বাচনে কারচুপির যে নতুন মডেল দেখলাম, তাতে আমরা শঙ্কিত।’

গত পাঁচ বছর বরিশালে মেয়র ছিলেন বিএনপির আহসান হাবিব। তাঁর মেয়াদে বরিশালে তেমন উন্নয়ন হয়নি। নগরের ভোটারদের এ নিয়ে যেমন ক্ষোভ আছে, তেমনি বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মনে করেন মেয়র হিসেবে সফলতা দেখাতে পারেননি তিনি।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত পাঁচ বছরে নগরের রাস্তাঘাটের অধিকাংশ ভেঙেচুরে বেহাল। এর আগের মেয়র আওয়ামী লীগের প্রয়াত শওকত হোসেন বরিশাল নগরকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন। আহসান হাবিব মেয়র হয়ে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা তো দূরে থাক, রক্ষণাবেক্ষণও করতে পারেননি। বিএনপিদলীয় বর্তমান মেয়রের ব্যর্থতার দায় সরোয়ারের মাথায় বর্তাচ্ছে, যা বিএনপির ভোটের সমীকরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে এটাকে সমস্যা মনে করছেন না মজিবর রহমান সরোয়ার। তিনি বলেন, সমস্যা হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। মানুষ খুলনা, গাজীপুরে ভোটের যে দৃশ্য দেখেছে, তাতে সুষ্ঠু ভোট হবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কা আছে। তাঁর মতে, বরিশাল এমনিতেই বিএনপির ঘাঁটি। সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির পক্ষে এবারও ভোট-বিপ্লব হবে।

আওয়ামী লীগ অবশ্য এমন ধারণাকে আর আমলে নিতে চায় না। দলটির নেতারা বলছেন, গত নয় বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছেন। এ জন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। তা ছাড়া গত পাঁচ বছরে বিএনপির মেয়র এখানে কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। গত নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দিয়ে মানুষ ঠকেছে।

নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নগরবাসী বুঝে গেছে, আওয়ামী লীগ জয়ী না হলে এখানে উন্নয়ন হবে না। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে হলে সাদিক আবদুল্লাহকে জয়ী করার বিকল্প নেই। এবার প্রায় ৩১ হাজার নতুন ভোটার। তাঁরা উন্নয়নের পক্ষে।

২০১৩ সালে বরিশালে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ১১ হাজার ২৫৭ জন। হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী এখন ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬।

আরও ছয় প্রার্থী

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার মেয়র পদে আটজন প্রার্থী। আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুজন ছাড়া অন্য প্রার্থীরা হলেন জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওবায়দুর রহমান, বাসদের মনীষা চক্রবর্তী, সিপিবির আবুল কালাম আজাদ, খেলাফত মজলিসের এ কে এম মাহবুব আলম ও স্বতন্ত্র বশির আহম্মেদ। তবে আইনি জটিলতার কারণে ইকবাল ও বশিরের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। তাঁরা এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী শুরুতে দলীয় প্রার্থী দিলেও পরে সমঝোতা হয়েছে এবং মজিবর রহমান সরোয়ারকে সমর্থন দিয়েছে।