চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আমের ফলনও বেশি, চাষিদের ক্ষতিও বেশি

ক্রেতার চেয়ে যেন বিক্রেতাই বেশি। ছবিটি তোলা হয়েছে দেশের অন্যতম বড় আম বাজার শিবগঞ্জের কানসাট থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
ক্রেতার চেয়ে যেন বিক্রেতাই বেশি। ছবিটি তোলা হয়েছে দেশের অন্যতম বড় আম বাজার শিবগঞ্জের কানসাট থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

আমের রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আমের উৎপাদন যেমন সবচেয়ে বেশি, তেমনি আম চাষি ও আম ব্যবসায়ীদের ক্ষতিও সবচেয়ে বেশি। কৃষি বিভাগ ও আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। 

‘১৪ বছরের আম উৎপাদন ও ব্যবসায়ী জীবনে আমের এমন দরপতন কখনো দেখিনি’—বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে এমন কথাই বলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটের মো. শাহজাহান (৪৫)।

মো. শাহজাহান বলেন, ‘এবার উৎপাদন খরচই উঠবে না। লাভের মুখ দেখেছে শিবগঞ্জে এমন আম চাষি ও ব্যবসায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবার আম ব্যবসায় ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। এর অর্ধেকও উঠে আসবে না। এখানকার বিখ্যাত দুটি জাত ক্ষীরসাপাত (হিম সাগর) ও ল্যাংড়া এখন প্রায় শেষ। এ দুটি জাতের আম বিক্রি করে চাষি ও ব্যবসায়ীরা কোনো লাভ করতে পারেনি। আশা ছিল, ফজলি আমে হয়তো কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সে আশাতেও গুঁড়েবালি পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় আম বাজার কানসাটে এখন ফজলি আমের মণ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা দরে। তাও আবার এ ‘মণ’ হয় ৪৬ বা ৪৭ কেজিতে।’

তরুণ উদ্যমী আম চাষি ও আম চাষি সংগঠক হিসেবে ইতিমধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় পরিচিতি পেয়েছেন শিবগঞ্জের সেলিমাবাদের ইসমাইল হোসেন খান (৩৩)। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাগানসহ তাঁর কয়েকটি বাগানে এবার আম উৎপাদিত হয়েছে এক হাজার ৫০০ মন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর মধ্যে ৭০০ মন আম বিক্রি করেছি বলতে গেলে পানির দরেই। মনে করেছিলাম, রোজা ঈদের পর বাজার চাঙা হবে। কিন্তু তা হয়নি। গত দুই তিন দিন থেকে ক্ষীরসাপাত আম চার হাজার টাকা ও ল্যাংড়া আম আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা মন দরে বিক্রি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এ বাড়তি দরের আম এখন তেমন একটা নেই বললেই চলে। ফজলির বর্তমান বাজার দরও হতাশাজনক। শুরু থেকে এ পর্যন্ত এর মণ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে। খুব বেশি হলে এক হাজার টাকা। ২০১৩ সালে যখন ঢাকার রাস্তায় আম ধ্বংস করা হতো। আমের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার ছিল। তখনো এত কম দরে আম বিক্রি হয়নি। এ বছর মে মাসের শেষ দিকে সাতক্ষীরার আম ঢাকার রাস্তায় ধ্বংস করা হলো। এর নেতিবাচক প্রভাব সারা দেশের আমের ওপরেও পড়েছে।

আম আর আম। কিন্তু চাষিদের মুখে হাসি নেই। কারণ তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী মূল্য পাচ্ছেন না। কানসাট বাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
আম আর আম। কিন্তু চাষিদের মুখে হাসি নেই। কারণ তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী মূল্য পাচ্ছেন না। কানসাট বাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

ইসমাইল হোসেন খান আরও বলেন, ‘রপ্তানির আশায় ৭০০ মন আমে ফ্রুট ব্যাগ (চীন থেকে আমদানি করা বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যাগ) পরিয়েছিলেন। ঢাকার ফল ও সবজি রপ্তানিকারকের সঙ্গে চুক্তিও ছিল আম রপ্তানির। তবে সেই চুক্তি ছিল দুর্বল। রপ্তানিকারকদের বাধ্য করার কোনো শর্ত নেই সেই চুক্তিতে। পরিমাণও উল্লেখ ছিল না। তবে আশা করা হয়েছিল এবারে কমপক্ষে ১০০ টন আম রপ্তানি হবে শিবগঞ্জ থেকে। কিন্তু হয়েছে মাত্র তিন টন। এ ছাড়া যেসব কোম্পানি আমের পাল্প তৈরির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজার থেকে আম কেনে—তারাও আম কিনেছে পানির দরে এবং পরিমাণও কম।’

কথা হয় আম ব্যবসায়ী মেসের আলী, নজরুল ইসলাম, কাজী এমদাদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের সকলের কণ্ঠেই এবারের আমের দর নিয়ে হতাশার সুর।

আমের দরপতনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হোদা প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার তুলনায় এবার আম উৎপাদন হয়েছে বেশি। গতবারের উৎপাদন ছিল প্রায় দুই লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া আমের বহুমুখী ব্যবহার বাড়েনি। রপ্তানি বাড়েনি।

মঞ্জুরুল হোদা বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, আম একটি নিরাপদ খাদ্য। রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো আম যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, তাও বলা হয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমে এর তেমন প্রচার দেখা যায়নি। অন্যদিকে ঢাকার রাস্তায় সাতক্ষীরার আম ধ্বংস হয়েছে। এর ফলাও প্রচার হয়েছে। আম নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা আমাদের বন্ধু-বান্ধবরাই আমাদের কাছ থেকে নিরাপদ আম চেয়েছে। তাঁরা ঢাকার বাজার থেকে কিনতে ভয় পেয়েছে।’ মঞ্জুরুল হোদা এ অবস্থা উত্তরণে চাষিদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে এবং সম্মিলিতভাবে আমের ইতিবাচক প্রচার ও ব্যবস্থা বাড়াতে পরামর্শ দেন।