মূল সমস্যাগুলো দূর করার অঙ্গীকার নেই

সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে।  ছবি: রয়টার্স
সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে। ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সই হওয়া সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) বাস্তুচ্যুত ওই জনগোষ্ঠীর মূল সমস্যাগুলো দূর করার অঙ্গীকার নেই। নাগরিকত্বসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে সমঝোতা স্মারকটি শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে শুরুতেই সংশয় দেখা দিল।

মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সই হওয়া এমওইউ বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত মাসে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সঙ্গে মিয়ানমার সমঝোতা স্মারকটি সই করে।

গত সপ্তাহে ফাঁস হওয়া ওই সমঝোতা স্মারক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রোহিঙ্গারাও। রোহিঙ্গাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের (এফআরসি) অন্যতম সমন্বয়কারী নে সেন লুইন প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের উচিত ছিল সমঝোতা স্মারক সইয়ের আগে শিবিরে অবস্থানরত, মিয়ানমারে থাকা কিংবা প্রবাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করা। শেষ পর্যন্ত যেটি সই হয়েছে, তাতে নাগরিকত্বের অধিকার নেই। চলাফেরার স্বাধীনতার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। সেই সঙ্গে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা কী হবে, সেটাও অনিশ্চিত। এমন এক পরিস্থিতিতে এই সমঝোতা স্মারক রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরতে মোটেই উৎসাহিত করবে না।

প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ সমঝোতা স্মারক নিয়ে বিতর্ক চলার মধ্যেই এ মাসের ১ থেকে ৪ তারিখ মিয়ানমার সফর করেছে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। ইয়াঙ্গুনের একটি কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, জাতিসংঘের আঞ্চলিক পরিচালকের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলটি রাখাইনে সাতটি এলাকা ঘুরে সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। 

রোহিঙ্গা শব্দ বাদ

ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনে জাতিসংঘের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সমঝোতা স্মারকের প্রাথমিক খসড়া দিয়েছিল মিয়ানমার। ওই খসড়ায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকারের বিষয়টি যুক্ত করেছিল জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। এ নিয়ে মিয়ানমার আপত্তি তোলে। বেশ কিছুদিন সময়ও চলে যায়। পরে নাগরিকত্বের প্রসঙ্গে ছাড় দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তাতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি একবারের জন্যও বলা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় ২ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গা শব্দটি নিয়ে আমাদের মতপার্থক্য তো স্পষ্ট। আমরা মিয়ানমারের ওই জনগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা বলেই ডাকি। আর মিয়ানমার তাদের বাঙালি মুসলমান বলে অভিহিত করে। তাই রোহিঙ্গা শব্দটি নেই।’

সমঝোতা স্মারকে বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের অন্য নাগরিকদের মতোই ফিরে আসা লোকজন বিদ্যমান আইন ও নিয়ম অনুযায়ী অবাধে চলাফেরার সুযোগ পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমারের সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তালিকায় এখনো স্বীকৃতি নেই রোহিঙ্গাদের। তা ছাড়া ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পর তাদের অধিকার অনেকখানি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিতে মিয়ানমার জোর দিচ্ছে। শর্ত যুক্ত করতে চাইছে। অথচ নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী তালিকার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। আর জাতিসংঘের সঙ্গে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকে মিয়ানমার শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরানোর কথা বলছে। 

বিচ্ছিন্ন গ্রামের পরিকল্পনা

রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার পর বিচ্ছিন্ন কিছু গ্রামে রাখার পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার। গত মাসে ইয়াঙ্গুনের একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার পর এবার অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের (আইডিপি) শিবিরের পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন গ্রামে রাখতে যাচ্ছে মিয়ানমার। আইডিপির বিষয়ে সমালোচনা থাকায় এবার মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইছে, রোহিঙ্গাদের গ্রামে রাখা হচ্ছে। শিবিরে নয়। যদিও যে গ্রামগুলো তৈরি হবে, সেগুলোতে শুধু রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নভাবে রাখা হবে।