মঞ্জুরকে তড়িঘড়ি 'হত্যাকারী' হিসেবে প্রচার

মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড: লরেন্স লিফশুলৎজ
মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড: লরেন্স লিফশুলৎজ

‘যারা আক্রান্ত হয়নি, যতক্ষণ না 

তারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মতো 
ফুঁসে উঠছে, ততক্ষণ পর্যন্ত 
ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।’
—বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন

আখ্যান
১৯৮১ সালের ১ জুন মধ্যরাতে চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মো. আবুল মঞ্জুর সেনানিবাসে সামরিক হেফাজতে থাকার সময়ে রহস্যজনকভাবে নিহত হন। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে মঞ্জুর নিজের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের উচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’ খেতাব।
মঞ্জুরকে যাঁরা চিনতেন, সবাই তাঁর সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তিনি একজন মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তার পরও চট্টগ্রাম সফররত অবস্থায় ৩০ মে ১৯৮১ জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হলে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে জিয়া-সরকার উৎখাতে অভ্যুত্থান সংগঠিত করার অভিযোগ তোলেন। এরশাদের সহযোগীরাও এর সঙ্গে গলা মেলান।
সেনা সদর দপ্তর থেকে যে গল্পটি ছড়ানো হয়, তা নিয়ে শুরু থেকেই জনমনে ব্যাপক সংশয় ছিল। আমরা যারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছি, তাদের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে এই সুপরিকল্পিত গল্প ছড়ানোর পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। যাঁদের ঘটে কিছু আছে, তাঁরা জানতেন, এই ‘দাপ্তরিক গল্প’-এর টালমাটাল ‘সত্য’কে বুঝতে হলে কঠোরভাবে যা অনুসরণ করতে হবে, তা হলো সন্দেহের মৌলিক দিকনির্দেশনা।
চট্টগ্রামে কী ঘটেছে, তা নিয়ে সেনা কমান্ড প্রথম দিন সুবিন্যস্ত, সরল ও সুসমন্বিত ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছড়ায়। জিয়া হত্যার ১২ ঘণ্টা পর এটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গল্পটা এ রকম: মেজর জেনারেল মঞ্জুর ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে অভ্যুত্থান করেছেন, যার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা।
কিন্তু চট্টগ্রামের খবরটাই ছিল গোলমেলে। মঞ্জুরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার উদ্দেশ্য যদি হয় জিয়াকে হত্যা করে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, তাহলে নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি ছক কেটে দেখার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল বলে মনে হচ্ছে না।
সে সময় যাঁরা তাঁর পাশে ছিলেন এবং এখনো জীবিত রয়েছেন, তাঁরা বলেছেন, মঞ্জুরের মধ্যে তাঁরা যে চাঞ্চল্য ও দ্বিধা দেখেছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে তিনি নিজেই ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। তিনি সময় ক্ষেপণ করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। আর যা-ই হোক, অভ্যুত্থানের সতর্ক পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারীর আচরণ তা হতে পারে না।
বাংলাদেশের মানুষ অভ্যুত্থানের সঙ্গে পরিচিত। তারা জানে, কীভাবে তা সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। রক্তমাখা হাতে যাঁরা ক্ষমতা দখল করেন, তাঁরাও এক ‘গল্প’ ফেঁদে বসেন। কিছুদিন তা চলেও। তবে সময় এলে সেই ‘আখ্যান’ ভেঙে পড়ে। ‘ছয় মেজর’ মিলে ‘পুরো ঘটনাটি কীভাবে ঘটাল’ তার ‘কার্যকরী খসড়া’র তত্ত্ব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এই অভ্যুত্থানের পেছনে যে দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা ও বিশদ যোগাযোগ সক্রিয় ছিল, ছায়ার জগৎ থেকে ধীরে ধীরে তা আলোতে চলে আসে। মার্কিন দূতাবাসের একটি অংশের সঙ্গেও অভ্যুত্থানকারীদের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর অধীনদের এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে চমকপ্রদ গল্প শোনা যায়। কিন্তু অভ্যুত্থান হয়ে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন, দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তিনি তাঁর নির্দেশ পালন করাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের নির্দেশদাতা ছিল অন্য কোথাও। সেই গল্পের তল খুঁজতে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়। (দেখুন, ‘অতীতের মৃত্যু নেই: ১৯৭৫-এর আগস্ট অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ছায়া’, লরেন্স লিফশুলৎজ, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০০৫)।
সে বছর আমি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে বসবাস করলেও ৩০ মে ১৯৮১ তারিখে, চট্টগ্রামে জিয়া হত্যার সময়, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে আমি ভারতের বিহারে ছিলাম। খবরটা শোনার পর আমি কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। তিন দিন পর বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে রওনা দিই ঢাকার দিকে।
ঢাকায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি অনেক তথ্য জোগাড় করে ফেলি। সেই সপ্তাহেরই শেষ দিকে পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সে সময় অনেক বিদেশি সাংবাদিকই ঢাকায় অবাঞ্ছিত ছিলেন। মুজিববিরোধী অভ্যুত্থান ও কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের ওপর লন্ডন থেকে একটি বই প্রকাশ করার কারণে আমি ইতিমধ্যেই ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হয়ে পড়েছিলাম।
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিচের প্রতিবেদনটি আমি ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে পাঠাতে সক্ষম হই। ঢাকার ডেটলাইনসহ এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের ১০ জুলাই:
‘বিদ্রোহ চলাকালে যা ছড়ানো হয়েছিল, তার চেয়ে ভিন্নতর খবর এখন ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, এ বিদ্রোহ মঞ্জুরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা যথেষ্ট সন্দিহান। সেনাসূত্র অনুযায়ী, ৩০ মে জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঢাকার সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মঞ্জুর ফোন করে জানান যে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মোটেই জড়িত নন। সবকিছু ঘটেছে তাঁর অজ্ঞাতসারে। তাঁকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, চট্টগ্রামের ঘটনার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরে তিনি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
‘বহু তথ্যের সত্যতা এখনো নিশ্চিত করা না গেলেও সেনাসূত্র দাবি করেছে, গৃহযুদ্ধ রোধে মঞ্জুর যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রথম দিন বিকেলেই তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরশাদের নির্দেশে ঢাকা রেডিও থেকে মঞ্জুরের বিরুদ্ধে এই মর্মে অবিরাম প্রচারণা চালানো হয় যে তিনি “খুনি” ও “বিশ্বাসঘাতক”। মঞ্জুর সে সময় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানানো হয়েছে।...তিনি মনে করেছিলেন, ঢাকা গ্যারিসনে অবস্থানরত তাঁর শত্রুরা, বিশেষত এরশাদ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল মহাব্বত জান চৌধুরী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাঁকে খতম করে দেবে।
‘...ব্যাপক ধোঁয়াশা সৃষ্টি হওয়ায় জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা মহিউদ্দীন আহমেদ সেনা হেফাজতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি খোলাসা করার জন্য ২১ জুন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ মৃত্যু সম্পর্কে সংবাদপত্রের কাছে বিবৃতি দিয়েছিল। সরকারি মুখপাত্রের দেওয়া বিবরণের সঙ্গে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কর্তৃপক্ষের এমন স্ববিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দীন আহমেদ দাবি করেন, বিচারের আগে মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যাকারী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তা তাঁকে জানাতে হবে।’ (‘কনফিউশন ওভার এ কিলিং’, লরেন্স লিফশুল্ৎজ্, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ১০ জুলাই ১৯৮১)।

মামলা
১৯৯৫ সালে, হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর, মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর আহমেদ জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম মঞ্জুর হত্যা সংঘটনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ইতিমধ্যে জেনারেল এরশাদের এক দশকব্যাপী সামরিক একনায়কত্বের অবসান ঘটেছে। ১৯৭১ সালে অন্য সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধ করে জীবনদান করলেও এরশাদ সে সময় পাকিস্তানে ছিলেন। অবশেষে মঞ্জুরের ভাই প্রাণ আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়ায় নিরাপদে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা গেল।
আর মঞ্জুরের ভাই মামলা দায়ের করার প্রায় দুই দশক পরে এখন ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’ সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিচ্ছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সেশন জজ হোসনে আরা আকতারের এই মামলার রায় ঘোষণা করার কথা ছিল। তাঁকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন খন্দকার হাসান মাহমুদ ফিরোজ। এই হঠাৎ পরিবর্তনের রহস্য কী, তা কেউ জানে না।
তবু সবাইকে আজ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে। বিচারক হোসনে আরা আকতার ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দিয়ে দিলেই কি ন্যায়বিচার সম্পন্ন হতো? ১৯ বছর ধরে চলা এই দীর্ঘ ও দুর্বল প্রসিকিউশনের পর এ গুরুতর সন্দেহের কারণ ঘটেছে যে বিচারিক আদালত যদি শেষ পদক্ষেপ নিয়ে রায় ঘোষণাও করতেন, তাহলেও তাঁর পক্ষে সত্যিই কোনো অর্থপূর্ণ রায় দেওয়া সম্ভব হতো কি না। এমনকি চূড়ান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিচারপতির পক্ষে শেষ মুহূর্তে রায় প্রদান থেকে দূরে থাকারও সমূহ কারণ ছিল।
২০১৩ সালের নভেম্বরে বিচারক হোসনে আর আকতার অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আসাদুজ্জামান খানকে তাঁর প্রস্তুতিহীনতার জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। আসাদুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীদের এই অযোগ্যতা কি শুধুই অযোগ্যতা, নাকি এ-ও কোনো পরিকল্পনা? আরেকজন সরকারি কৌঁসুলি আবুল কাশেম খান ২ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে ১৯৯৫ সালে এই মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২২ বার এর বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে।
সাধারণত এ ধরনের জটিল মামলায় একজন বিচারককেই সব জট খোলার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিই একে নিশ্চয়তার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিশ্বজুড়ে এটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ মানদণ্ড। কিন্তু এই মামলাটি প্রমিত মানের ধারে-কাছে দিয়েও যায়নি। এই মামলাটিকে ভবঘুরে এতিমের মতো এক বিচারক থেকে আরেক বিচারক এবং এক কৌঁসুলির কাছ থেকে আরেক কৌঁসুলির কাছে পাঠানো হয়েছে। তার পরও এই মামলার গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রয়েছে এর তাৎপর্য।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মঞ্জুরের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কি না, বিচারক খন্দকার ফিরোজের নিয়োগের মধ্য দিয়ে সেটি কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ল। এখানে উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরের পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে ৩৫ বছর পর। মঞ্জুর ও তাহের উভয়েই বীর উত্তম খেতাবধারী—যা এরশাদ পাননি, জিয়া পেয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে জিয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়টা এরশাদ কাটিয়ে দেন পাকিস্তানে বসে। জিয়া আর মঞ্জুর—এই দুজনের মৃত্যুর ঘটনাতেই এরশাদ ফেঁসে যেতে পারেন।
জেনারেল এরশাদের আইনজীবী দাবি করেছেন, একজন সাক্ষীও এরশাদ বা তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে মঞ্জুর হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে সাক্ষ্য দেননি। সে কারণে তাঁকে এই অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হোক যে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা, অনেকে যাকে বলে থাকেন পূর্বপরিকল্পিত ‘হত্যা’, তাতে তিনি একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
জেনারেল এরশাদ ‘সাধারণ সন্দেহভাজন’কে আটক করে আসল অপরাধীকে এড়িয়ে যাওয়ার সেই পুরোনো পুলিশি কৌশলের সুবিধাভোগী হয়েছেন। তবে এ দাবিও কেউ করতে পারবে না, কারণ গত ৩৩ বছরে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিও মঞ্জুর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হননি।
চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১৯৮১ সালের ঘটনাপ্রবাহের ওপর একটি সুচিন্তিত বই লিখেছেন। ১৯৮১ সালের ১ জুন সংঘটিত মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডকে তিনি অভিহিত করেছেন চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘দ্বিতীয় খুন’ বলে। জিয়াউর রহমান ছিলেন ‘প্রথম’ খুনের শিকার। জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ভিন্ন ধাতুর মানুষ। তিনি গুরুতর প্রশ্ন তোলেন, আবার উত্তরের জন্য দুরূহ উপায় খোঁজেন।
জিয়াউদ্দীনের ভাষ্য হচ্ছে, জিয়া ও মঞ্জুর উভয়েই খুন হয়েছেন। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যিনি চট্টগ্রামের সেই নিয়তি-নির্ধারক দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সময় দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অনুসন্ধান পরিচালনা করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। জিয়াউর রহমান ও আবুল মঞ্জুর উভয়েরই পরিচিত হওয়ায় তাঁর অবস্থানটি ছিল অনন্য। 
২০০৯ সালে প্রকাশিত হলেও জিয়াউদ্দীন চৌধুরী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন, সরকারি কৌঁসুলির কার্যালয় বা তদন্তকারীরা কেউই তাঁর দ্য অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড ইট্স্ আফটারম্যাথ বইয়ে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে তাঁর কাছে কিছু জানতে চাননি।
একইভাবে কয়েক বছর আগে ঢাকায় মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমার দুই দিন বসার সুযোগ হয়। আমরা দুজন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সময়কার ঘটনাবলি মনে করার চেষ্টা করি। মেজর জেনারেল মইনের সঙ্গে আমার ৩০ বছরের জানাশোনা। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশের মিলিটারি অ্যাটাশে হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমি তখন সাংবাদিকতা থেকে ছুটি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, তাঁর কাজ ছিল আমার ওপর নজর রাখা। আমার তরফ থেকেও অনেকটা এ রকম ব্যাপার ছিল বলে আমি জানিয়েছিলাম। এ উদ্দেশ্যে আমরা ঘন ঘন নৈশভোজে মিলিত হতাম।
এক দশক আগে জেনারেল মইন বাংলায় একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক। ২০০৬ সালে যখন তাঁর সঙ্গে বসি, তাঁকে তখন বলেছি, তিনি যেন বইটির নির্দিষ্ট কিছু অংশের বিষয়বস্তু আমাকে বিশদভাবে জানান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি বাংলা পড়তে পারি না। এর পরের কয়েক বছর আমি ও মইন একে অপরের কাছ থেকে নানা কিছু জানার চেষ্টা করেছি। বইটির ইংরেজি তর্জমা কবে পাব, তা অনিশ্চিত হওয়ায় সেই দুই দিন চট্টগ্রামে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত ঘটনাবলির ওপর আমরা যতটা পারি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেছি।
আলোচনার নোটসমেত প্রস্থানের সময় মইন বললেন, তিনি বইটির একটি ইংরেজি তর্জমা করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ২০১০ সালে তাঁর অসময়োচিত মৃত্যুর আগেই বইটির ইংরেজি তর্জমা আমার হাতে এসে পৌঁছায়। দশমবারের মতো এই অনুবাদটি যখন আমি পড়ছি, তখন সেই সময়কার চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহের ওপর মইনের জ্ঞানের পরিধিকে বৃহত্তর পরিসরে জানানোর এক দায় বোধ করছি। ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখার এক অনুকূল অবস্থান তাঁর ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে তাঁর কর্মস্থল ছিল সেনাসদর।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মঞ্জুর তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ সময় ফোনে ঢাকায় কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। যাঁদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, তাঁরা ছিলেন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। দৃশ্যপট থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ায় আমরা কখনোই জানতে পারব না যে তিনি কাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, কী বিষয়েই বা সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন।’
তবে জিয়াউদ্দীনকে এ নিয়ে আর আক্ষেপ করতে হবে না। কারণ, আমরা এখন জানি, মঞ্জুর সেই চরম সময়ে সেনা সদর দপ্তরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী। মঞ্জুর তাঁকে বিশ্বাস করতেন। আর সেনাসদরে তখন মইনই ছিলেন একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা।
বাকী অংশ পড়তে ক্লিক করুণ