তিন সিটিতে অভিযোগ, আশঙ্কা ও আশ্বাস

>

• তিন সিটিতে ৩০ জুলাই নির্বাচন
• মঙ্গলবার থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছে
• সবার জন্য সমান সুযোগ আছে: সিইসি
• বরিশাল-রাজশাহীতে সহিংসতার আশঙ্কা
• সিলেটে বাড়ি বাড়ি তল্লাশির অভিযোগ

অভিযোগ, আশঙ্কা ও আশ্বাস—এসবের মধ্য দিয়ে চলছে বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের প্রচার। বিরোধী প্রার্থীরা প্রতিদিনই তাঁদের নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার করার অভিযোগ তুলছেন। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ, তারা সরকারদলীয় প্রার্থীদের কাজকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি আছে এবং তা থাকবে। তিনি এখনো আশা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নেবে।

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক সভা শেষে সিইসি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে সিইসি সমান সুযোগের কথা বললেও এরই মধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন ও নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপির প্রার্থীদের অভিযোগ, একদিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের পোস্টার লাগানো ও জনসংযোগে বাধা দিচ্ছেন, অন্যদিকে পুলিশ কারণ ছাড়াই তাঁদের নেতা-কর্মীদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে।

সিলেটে গত বুধবার দিবাগত রাতে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় দুই বিএনপি কর্মীকে ধরে পুলিশে দেন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, ওই দুজন তখন ধানের শীষের পোস্টার সাঁটাচ্ছিলেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক তাৎক্ষণিক থানার সামনে অনশনের ঘোষণা দিয়ে অবস্থান শুরু করলে পুলিশ ওই দুজনকে ছেড়ে দেয়।

খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগেও নির্বাচন কমিশন সব দলকে সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু দুই শহরেই নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মী ও এজেন্টদের ধরপাকড় করা হয়েছিল। 

নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের নির্দেশনা
তিনটি সিটি করপোরেশনেই গত মঙ্গলবার থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। ৩০ জুলাই নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক সভা শেষে সিইসি কে এম নুরুল হুদা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিন সিটি নির্বাচন যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেই নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথাও ইসি শুনেছে। সবার আশা, সুষ্ঠুভাবে এই তিন সিটির নির্বাচন করা সম্ভব হবে। বাড়তি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার হবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সিটিগুলোতে নির্বাচনের পরিবেশ-পরিস্থিতি সঠিক রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। সেখানে কোনো ধরনের ঝুঁকি বা আশঙ্কার বিষয় নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করতে গেলে অভিযোগ আসতেই পারে। তবে অভিযোগ সঠিক কি না, তা দেখতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণ করতে হবে।

সিইসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্য চার নির্বাচন কমিশনার, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‍্যাবের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং তিন সিটি করপোরেশনসংশ্লিষ্ট পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অংশ নেন। 

বরিশাল ও রাজশাহীতে সহিংসতার আশঙ্কা
আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক বৈঠক সূত্রে জানা যায়, তিন সিটিতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও নির্বাচনী এলাকায় সন্দেহভাজন অনুপ্রবেশকারী রোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে যেন হয়রানি বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয় এবং নিরপরাধ বা বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে।

তবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। পুলিশের একজন কর্মকর্তা প্রশ্ন রাখেন, তাহলে কি নির্বাচনকালীন ওই সব এলাকায় ছিনতাই বা এ ধরনের অপরাধ হলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না?

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার না করার বিষয়টি তাঁরা গণমাধ্যমের বরাতে জেনেছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক চিঠি পাননি। পরে একজন নির্বাচন কমিশনার পুলিশকে সিআরপিসি অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।

সূত্র জানায়, বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বরিশালে নির্বাচনের সময় সহিংসতা হতে পারে মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রাজশাহীর কাজলা ও মতিহার এলাকায় একসময় জঙ্গি তৎপরতা বেশি ছিল বিধায় ওই এলাকায়ও আলাদা দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মত দিয়েছে।

বিদেশি কূটনীতিকেরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যেতে পারেন কি না, সে প্রশ্নও তোলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা। নিরাপত্তার খাতিরে কূটনীতিকেরা গেলে আগে থেকেই তাঁদের বিষয়টি জানানোর পরামর্শ দেন তিনি। 

সিলেটে বাড়ি বাড়ি তল্লাশির অভিযোগ
নির্বাচন সামনে রেখে সিলেটে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই নেতা-কর্মীদের ধরতে পুলিশ এই তল্লাশি চালাচ্ছে।

নগর বিএনপির সহসভাপতি সালেহ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, গত এক সপ্তাহে ৩০-৪০ জনে নেতা-কর্মীর বাসায় পুলিশ গেছে। অধিকাংশ নেতা-কর্মী নিজেদের বাসায় থাকছেন না।

এই পরিস্থিতিতে বুধবার রাতে বিএনপির দুই কর্মীকে মারধর করে পুলিশে দিলে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা কোনো মামলা ছাড়া ধানের শীষের কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের ঘোষণা দেন তিনি।

আরিফুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে না। তিনি বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে এবং রিটার্নিং অফিসারকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। 

রাজশাহীতে পুলিশি অভিযানের অভিযোগ
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রচারের দ্বিতীয় দিনেই বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পোস্টার-ফেস্টুন ছেঁড়া ও প্রচারে বাধা দেওয়া এবং নেতা-কর্মীদের মারধর ও বাড়ি বাড়ি পুলিশের অভিযানের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির প্রার্থী কাশিয়াডাঙ্গা থানা, বোয়ালিয়া থানা ও ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহারের দাবি জনিয়েছেন।

বিএনপির প্রার্থীর পক্ষ বুধবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

 মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক জানান, বুধবার রাতে নগরির অলকার মোড়ে পোস্টার লাগানোর সময় যুবদলের কর্মী হিটনকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। এরপর তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম কোনো ঘটনা অতি-উৎসাহী কোনো আওয়ামী লীগ কর্মী ঘটিয়ে থাকলে, খোঁজখবর নিয়ে প্রমাণ মিললে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

বরিশালে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ
বরিশালে বুধবার নির্বাচন কমিশনের কাছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে বিএনপি। এতে বলা হয়, ১০ জুলাই বেলা দেড়টায় চকবাজার, কাঠপট্টি ও সদর রোড এলাকায় নৌকা প্রতীকের মিছিল বের করা হয়। এ ছাড়া সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত ২১টি ওয়ার্ডে শোভাযাত্রা বের করেন নৌকার সমর্থকেরা। একই দিন দেড়টায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের জনসংযোগে পুলিশ বাধা দেয়।

মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আছেন। তাই প্রশাসনকে তাঁরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন বলে প্রথম থেকেই তাঁদের শঙ্কা। তিনি শহরে ঘোরাফেরা করছেন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী গোলাম আব্বাস চৌধুরী বলেন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ সাংসদ বা মন্ত্রী হিসেবে নন, জেলা সভাপতি হিসেবে দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন।