বিদ্যুৎ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে

>

• ২০১৭ সালে দগ্ধ হয়ে ৭৫৮ জন মারা যায় 
• দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ৪৮% ঘটে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে
• অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০০ রোগীর 
• ১৭০০০-এর বেশি রোগী এসেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে 
• চিকিৎসা নেওয়া মোট রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬৫,০০০

দেশে দগ্ধ হয়ে প্রাণহানির প্রায় অর্ধেক ঘটছে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায়। এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মৃত্যুর পাশাপাশি এতে অঙ্গহানির ঝুঁকিও বেশি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে গত বছর বিভিন্নভাবে দগ্ধ রোগীর (বহির্বিভাগে এবং ভর্তি থেকে) চিকিৎসা গ্রহণ, মৃত্যু ও অঙ্গহানির তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

২০১৭ সালে দগ্ধ হয়ে ৭৫৮ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে ৩৬৪ জন মারা যায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, যা মোট মৃত্যুর ৪৮ শতাংশ। এর আগের বছর আগুনে পুড়ে মারা যায় ৭৫৪ জন। তাদের ৪২ শতাংশ মারা যায় বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায়।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার ক্ষতি ও ভয়াবহতা খুব বেশি। এতে দগ্ধ
রোগীর উচ্চ মৃত্যুঝুঁকির পাশাপাশি অঙ্গহানির ঘটনার সম্ভাব্যতার হার অনেক বেশি। এ ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রিয় দলের পতাকা ওড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গত ১৫ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন রাজধানীর মিরপুরের তৌহিদী মোরশেদ (৪০)। জীবন বাঁচাতে শুরুতে তাঁর দুটি পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ২১ দিন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে ৬ জুলাই তিনি
মারা যান।

গত বছর বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বহির্বিভাগে এবং ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দগ্ধ ১৭ হাজারের বেশি ছিল। ২০১৬ সালে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দগ্ধের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজারের বেশি।

 নীলফামারীর রডমিস্ত্রি সাইফুল ইসলাম (২৬) ময়মনসিংহে একটি ভবন তৈরির কাজ করার সময় অসতর্কতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। তাঁর বাঁ হাত, বাঁ পা ও বুকের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে যায়। এখন তিনি বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হাত, পা ও বুকে ব্যান্ডেজ করা সাইফুল যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁর মা নুরুন নাহার বেগম পাশে বসে বাতাস করছেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছেলের এ অবস্থায় মা বলেন, ‘ছেলের চিকিৎসা চালাব না সংসারের কথা চিন্তা করব, বুঝতে পারি না। ছেলে তো আমার চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল।’ বাড়িতে সাইফুলের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় দগ্ধ রোগীর অঙ্গহানির ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। গত বছর এ ধরনের প্রায় ৫০০ রোগীর অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে। অনেক রোগীর চার হাত-পায়ের মধ্যে তিনটিই কাটা পড়েছে। ২০১৬ সালে অঙ্গহানির সংখ্যা ছিল ২০০-এর কম।

ডাম্পিং ট্রাকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন ১৮ বছরের মো. শরীফ। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় পুড়ে চার মাসের বেশি এই হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে।

শরীফ জানান, রাতে কাজ শেষ করে ট্রাক নিয়ে স্ট্যান্ডে ফেরার সময় একটি নিচু হয়ে ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক তার সরাতে যান তিনি। এ সময় হঠাৎ আসা বাতাসে তারটি শরীরে লাগে। এতে তাঁর শরীরের পিঠ থেকে নিচের দিকে ৬৭ শতাংশ পুড়ে যায়। শরীরের অনেক জায়গায় গভীর ক্ষত। শরীফ বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁর শরীরে চার বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা বাঁ পা বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দুর্ঘটনা ও উদ্ধারের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, তারা ২০১৬ সালে প্রায় ১৭ হাজার অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর প্রায় ৭০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ড বিদ্যুৎ-সংশ্লিষ্ট।

এই অধিদপ্তরের পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০০৬ এবং অগ্নি-প্রতিরোধ আইন ২০০৩ না মানা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এর পাশাপাশি বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ এবং নকল বা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামের ব্যবহারের ফলেও বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া জনগণের অসাবধানতার বিষয়টি আছেই।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বলেন, দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে গেলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসা উচিত। এতে অঙ্গহানির ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। আগুনে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, যেভাবেই দগ্ধ হোক, আক্রান্ত স্থানে প্রাথমিকভাবে স্বাভাবিক তাপমাত্রার প্রচুর পানি ঢালতে হবে। কোনোভাবেই বরফ, ঠান্ডা পানি, পেস্ট ও ডিম লাগানো যাবে না।