হঠাৎ উত্তাপ রাজশাহীতে

ককটেল বিস্ফোরণের পরপরই তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয় যুবককে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। গতকাল সকালে রাজশাহী শহরের সাগরপাড়ায়।  ছবিটি ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া
ককটেল বিস্ফোরণের পরপরই তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয় যুবককে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। গতকাল সকালে রাজশাহী শহরের সাগরপাড়ায়। ছবিটি ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া

হঠাৎ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা উত্তাপ ছড়াল রাজশাহীতে। বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীর পক্ষে দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল মঙ্গলবার সকালে গণসংযোগ করছিলেন। কর্মীদের নিয়ে তিনি যেখানে জড়ো হয়েছিলেন, এর কাছেই পরপর তিনটি ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বিস্ফোরণের পর স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে আহত হন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ তিনজন। এ ঘটনার জন্য বিএনপির নেতা দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগকে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিএনপি এ কাণ্ড ঘটিয়েছে।
রাজশাহী শহরের সাগরপাড়া বটতলার মোড়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় এ ঘটনা ঘটে। সেখানে গণসংযোগ করছিলেন বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনটি মোটরসাইকেলে করে এসে দুর্বৃত্তরা ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যায়। বিকট শব্দের পর চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভয়ে লোকজন ছোটাছুটি করতে থাকে। বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিরা হলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান, টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি আদিত্য চৌধুরী এবং স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন কর্মকার। তিনজনই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
হামলার পর পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) আমির জাফর প্রথম আলোকে বলেন, কে বা কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তা যাচাই করে দেখছেন তাঁরা।
১০ জুলাই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করে আসছে। এর মধ্যে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা নির্বাচনী পরিবেশকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ফোনে জানানো কর্মসূচি
বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মঙ্গলবারের কর্মসূচিতে এই গণসংযোগের তথ্য ছিল না। গত সোমবার রাতে স্থানীয় সাংবাদিকদের ফোন করে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার জানান, মঙ্গলবার সকালে সাগরপাড়া বটতলার মোড়ে গণসংযোগ করবেন তিনি। সকালে তিনি ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান, রাজশাহী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহিন শওকত, বাগমারা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জিয়াউর রহমান, নওগাঁ জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজিবুল্লাহ, রাজশাহী জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি রেজাউল কবীর, সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল সরকারসহ ১৫-২০ জন বটতলার মোড়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিএনপি নেতারা গণসংযোগের আগে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। এরপর তাঁরা বটতলা মোড়ের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তখনই ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল ককটেলের অংশবিশেষ।  ছবি: প্রথম আলো
বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল ককটেলের অংশবিশেষ। ছবি: প্রথম আলো


হামলাস্থল চার রাস্তার মোড়ে
ঘটনাস্থলটি ঠিক চার রাস্তার মোড়ে অবস্থিত। নগরের শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকে আসা সড়ক, রানীবাজার থেকে আসা সড়ক, সাধুর মোড় থেকে আসা সড়ক এবং কল্পনা সিনেমা হল থেকে আসা সড়ক এই মোড়ে মিলেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হামলাকারীরা শিরোইল বাস টার্মিনালের সড়ক দিয়ে এসে সাধুর মোড়ের দিকে চলে যায়।
ঘটনাস্থলের ঠিক উল্টো পাশে ছিলেন ডাব বিক্রেতা নূর ইসলাম। তিনি বলেন, তিনটি মোটরসাইকেল রাস্তায় ছিল। একটি মোটরসাইকেল থেকে সাদা গেঞ্জি পরা এক যুবক রাস্তায় নামেন। তিনি পরপর তিনটি ককটেল ছুড়ে মারেন। এরপর দৌড়ে ওই যুবক একটি মোটরসাইকেলে ওঠেন। এরপর মোটরসাইকেলগুলো দ্রুত চলে যায়।
হামলাকারী ছিল ছয়জন
ককটেলের বিস্ফোরণে আহত স্বপন কর্মকার মোড়ের কাছেই রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের বস্তার ছাউনি দেওয়া নিজের দোকানে কাজ করছিলেন। কাজে ব্যস্ত থাকায় ও মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় হামলাকারীদের কাউকে দেখেননি বলে জানান তিনি। তাঁর ছেলে প্রতীম কর্মকার ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। তিনি বলেন, তিনটি মোটরসাইকেলে করে ছয়জনকে তিনি পালিয়ে যেতে দেখেছেন। এর মধ্যে তিনজনের মুখে রুমালে বাঁধা ছিল।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ভিডিওতে ওই তিন মোটরসাইকেলের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়েছে। তবে হামলাকারীর চেহারা বা মোটরসাইকেল তিনটির নম্বরপ্লেটের ছবি ভিডিওতে স্পষ্ট নয়।
দুই ভাইকে দোষ দিল দুই পক্ষ
আহত তিনজনকে দেখতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান এবং রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার সেখানে যান। এ সময় ককটেল হামলা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক হয়। মিজানুর রহমান বলেন, লতিফ কাউন্সিলরের ছেলে আবেদ যে কিনা আওয়ামী লীগ করে সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় ডাবলু সরকার বলেন, তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে আবেদের ভাই জাবেদ যে বিএনপি করে, সে ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
আবেদ ও জাবেদের বাসা সাগরপাড়া এলাকায়। তাঁদের বাবা প্রয়াত আবদুল লতিফ ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার (কাউন্সিলর) ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। ঘটনার পর চেষ্টা করেও দুই ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

ককটেল বিস্ফোরণে একটি বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে যায়।  ছবি: প্রথম আলো
ককটেল বিস্ফোরণে একটি বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে যায়। ছবি: প্রথম আলো


পরস্পরকে দোষারোপ
ককটেল বিস্ফোরণের দুই ঘণ্টা পর মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। তাঁর অভিযোগ, বিএনপি নিজেরাই তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা চালিয়েছে। খায়রুজ্জামান দাবি করেন, তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে, রুহুল কুদ্দুস সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখান থেকে হয়তো হামলার নির্দেশ এসেছে।
তবে রুহুল কুদ্দুস বলেন, খুলনা ও গাজীপুরের মতো নির্বাচন করতে এবং নেতা-কর্মীদের বাড়িছাড়া করতে আওয়ামী লীগ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সভা
এদিকে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সিটি নির্বাচন নিয়ে বিভাগীয় সমন্বয় কমিটির সভা বসে। সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রধান অতিথি ছিলেন। সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত স্বাভাবিক।