প্রচারণায় আচরণবিধি লঙ্ঘন তিন সিটিতেই

রাজশাহী সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামানের পক্ষে গণসংযোগে খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক (ডানে)। গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস মোড়ে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামানের পক্ষে গণসংযোগে খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক (ডানে)। গতকাল সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস মোড়ে। ছবি: প্রথম আলো
>

• সিটি করপোরেশন নির্বাচন
• প্রচারে অংশ নিচ্ছেন সরকারি দলের একাধিক সাংসদ ও নির্বাচিত মেয়র।
• অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি ইসি।

রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট-তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেই ঘটছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা। কখনো প্রার্থীরা, কখনো তাঁদের পক্ষের নেতা-কর্মীরা আচরণবিধি না মেনে প্রচার চালাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় থাকা সাংসদ, মেয়ররাও বিধি অমান্য করে প্রচারে নেমেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি লিখিত অভিযোগ দিচ্ছেন ইসিতে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানা করার ক্ষমতা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।

৩০ জুলাই এই তিন বড় শহরে ভোট হবে। এ জন্য ১০ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে প্রচার। এরপর থেকে তিন সিটিতেই নিয়ম না মেনে প্রচারে এক ওয়ার্ডে একাধিক মাইকের ব্যবহার, মিছিল করা, বিলবোর্ড ব্যবহার, সার্কিট হাউস ব্যবহার ও বলপ্রয়োগ করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণ বিধিমালায় কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কেউ আচরণ বিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। আর কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচার করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী মন্ত্রী, সাংসদ, মেয়র প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। গত এপ্রিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আচরণবিধি সংশোধন করে সাংসদদের সিটি নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। ইসি তড়িঘড়ি করে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও পরে পিছু হটে। তবে আওয়ামী লীগের সাংসদেরা পিছু হটছেন না। নানাভাবে একাধিক সাংসদ নির্বাচনের মাঠে থাকছেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শুধু লিখিত অভিযোগ নয়, মৌখিকভাবেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ পেলে ইসির উচিত তাৎক্ষণিকভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখালে দায় ইসির ওপরই বর্তাবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই এসব বিষয়ে ইসির কঠোর হওয়া উচিত, তাতে ইসির ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে। সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি ‘ম্যানুয়েল’ প্রয়োজন।

বিধি লঙ্ঘন রাজশাহীতে
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাজশাহী-১ আসন থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী, রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ মো. আয়েন উদ্দীন এবং খুলনার নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককে গণসংযোগ ও প্রচারে অংশ নিতে দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহীর একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী। এ সময় তিনি ৩০ জুলাই নৌকাকে জয়ী করতে সবাইকে সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

এ বিষয়ে ওমর ফারুক চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রাজশাহী শহরের বাসিন্দা এবং এখানকার ভোটার। দু-চারটা কথা যে নির্বাচন নিয়ে বলিনি এমন না। কিন্তু মতবিনিময় সভাটি একটি বদ্ধঘরে এবং ভিন্ন ব্যানারে ছিল। এটা এমন কোনো বিষয় না।’

গত সোমবার বিকেলে নগরের দড়িখরবনা ঈদগাহ মাঠে সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নারী কর্মীদের নিয়ে খায়রুজ্জামানের নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নেন সাংসদ মো. আয়েন উদ্দীন। সেখানে তিনি খায়রুজ্জামান ছাড়া রাজশাহী নগরীর উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন এবং নৌকা প্রতীকে সবার ভোট চান। রাজশাহী-৩ আসনের এই সাংসদ গতকাল বৃহস্পতিবারও নগরীর বুলনপুর এলাকায় খায়রুজ্জামানের পক্ষে জনসংযোগে অংশ নেন।

মো. আয়েন উদ্দীন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি তিনি ওমরাহ থেকে ফিরেছেন। নেতা-কর্মীদের ইচ্ছা অনুযায়ী দড়িখরবনা ঈদগাহ মাঠে সেদিন তিনি তাঁদের খাওয়াদাওয়া করিয়েছিলেন। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়া যাবে না, এমন কোনো চিঠিও তাঁদের দেওয়া হয়নি।

খায়রুজ্জামানের প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। বুধবার থেকে তিনি শহরের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। গতকালও তিনি নগরের নিউমার্কেট এলাকায় গণসংযোগ করেছেন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কায়সার রহমান মিলনায়তনে একটি মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।

নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, মেয়র হিসেবে শপথ নিলেও তিনি এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তাই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে তাঁর কোনো বাধা নেই।

এই তিনজন প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। নির্বাচন উপলক্ষে ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ দল শহরে ঘুরছেন, বিষয়টি কি তাঁদেরও দৃষ্টিগোচর হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে আতিয়ার রহমান বলেন, কেউ তাঁকে এমন কিছু জানাননি। তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী সাংসদ বা মেয়র প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। আপনার কাছ থেকে বিষয়টি জানলাম। আমরা এখন সরাসরি মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলব।’


বরিশালেও একই অবস্থা
রাজশাহীর মতো বরিশাল সিটির নির্বাচন ঘিরেও উঠছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রচার শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি ১৬টি অভিযোগ দায়ের করেছে। এর মধ্যে গত শনিবার বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের পক্ষে ছয়টি এবং পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষে পাঁচটি লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। গত পাঁচ দিনে দুই দলের পক্ষ থেকে আরও পাঁচটি অভিযোগ দেওয়া হয়। তবে গতকাল পর্যন্ত এসব অভিযোগের বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দীন খান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত ১৬টি অভিযোগ পেয়েছেন। এসব অভিযোগ পাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তদন্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা প্রতিবেদন দেওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিছিয়ে নেই সিলেট
গত মঙ্গলবার সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে মতবিনিময়ের নামে নির্বাচনী সভায় সরকারি কর্মচারীরাও অংশ নেন। ওই দিনই জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ লিখিতভাবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন।

বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ দেওয়া হলেও ইসি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সিলেট সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া হাসপাতালে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সভা করার বিষয়ে সত্যতা পেয়েছি। সংশ্লিষ্টদের শিগগির নোটিশ পাঠানোর পাশাপাশি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রাজশাহী থেকে আহমেদ জায়িফ ও আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, বরিশাল থেকে এম জসীম উদ্দীন এবং সিলেট থেকে সুমনকুমার দাশ)