কালো পানিতে সাদা ফেনা

বর্ষাতেও তুরাগে পানির রং কালো, তাতে জমেছে রাসায়নিকের সাদা ফেনা। মনে হয় যেন ভাসছে বরফ। মত্রাতিরিক্ত দূষণে মাছও মিলছে না। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ী পাম্পহাউস এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
বর্ষাতেও তুরাগে পানির রং কালো, তাতে জমেছে রাসায়নিকের সাদা ফেনা। মনে হয় যেন ভাসছে বরফ। মত্রাতিরিক্ত দূষণে মাছও মিলছে না। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ী পাম্পহাউস এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

শম্ভু বর্মণ, পেশায় জেলে। তুরাগ নদের ধারে বাস। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে নদে মাছ পাচ্ছেন না তিনি। কারণ, তুরাগ নদের মাত্রাতিরিক্ত দূষণ। সম্প্রতি মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ী এলাকায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মিরপুর-উত্তরার সব ময়লা পানি ওই স্লুইসগেট দিয়া গাঙ্গে আইসা পড়ে। এতে কইরা সব মাছ পালাইছে। অহন ভরা বর্ষার অপেক্ষা করতাছি। তহন যদি মাছ কপালে জোটে।’

মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সড়কের বাঁ পাশ ঘেঁষে গোড়ান চটবাড়ী পাম্পহাউসের অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই পাম্পহাউস হয়ে দূষিত পানি নদে পড়ছে। এতে করে পানি ঘুটঘুটে কালো রং ধারণ করেছে। রাসায়নিক বর্জ্য পানিতে সাদা ফেনা হয়ে ভাসছে। অনেকটা বরফের চাঁইয়ের মতো। নদের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তা থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদে প্রায়ই রাসায়নিক বর্জ্য, মানুষের পয়োবর্জ্য ভাসতে দেখা যায়। নদের পানিতে গোসল করার উপায় নেই। পানি ব্যবহার করলেই দেখা দিচ্ছে চর্মরোগ। এই পানি ব্যবহারের ফলে জমির ফলনও কয়েক বছর ধরে আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় মুদিদোকানি আবদুর রহমান বলেন, ‘ওই যে ভাসতাছে, ওইডারে আমরা কই কালা পানির সাদা ফেনা। উত্তরা আর গোটা মিরপুরের ময়লা পানি এই দিক দিয়া তুরাগে পড়ে। মাছ পাওন যায় না। নদী মইরা গ্যাছে। ছোট থাইকতে নদীর পানি ছিল টলটলা। অহন তা ভাবাও যায় না।’

তুরাগ নদের দূষণ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান প্রথম আলোকে বলেন, গোড়ান চটবাড়ী পাম্পহাউসে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকায় দিন দিন তুরাগের দূষণ বাড়ছে। দ্রুত ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এর বাইরে বেড়িবাঁধ সড়ক ঘেঁষে পাউবোর জলাধার অঞ্চলটি দখল হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বেড়িবাঁধ সড়কের ডান পাশে রয়েছে পাউবোর ৬৩০ একর সংরক্ষিত জলাধার। এই জলাভূমিতে বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, উত্তরার ১, ৩, ৫, ৭, ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর সেক্টর এবং বৃহত্তর মিরপুরের পয়োবর্জ্যমিশ্রিত বাসাবাড়ির পানি ও রাসায়নিক তরল বর্জ্য এসে জমা হয়। জলাধারের পানির উচ্চতা সাড়ে তিন মিটারের বেশি হলে তা পাম্প করে জলকপাট দিয়ে নদে ফেলা হয়। পানি পাম্প করার জন্য ছয়টি পাম্প রয়েছে। প্রতিটি পাম্প সেকেন্ডে ২৫ লিটার পর্যন্ত পানি পাম্প করতে পারে। দূষিত পানি শোধন করার কোনো ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকায় পাম্পহাউস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দূষিত পানি নদে ফেলা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী খন্দকার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তরা থেকে মিরপুর পর্যন্ত শত শত গার্মেন্টস, ডায়িং কারখানা রয়েছে। তার পানি এই জলাধার এলাকায় এসে জমছে। এর বাইরে রয়েছে বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্য ও বৃষ্টির পানি। এত পানি ট্রিটমেন্ট করে নদে ফেলা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সার্ভের কাজ শেষ হয়েছে। পানি শোধনাগার স্থাপন করা গেলে তুরাগ নদ অনেকটাই দূষণমুক্ত হবে।’