একচেটিয়া প্রচারে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাজশাহী নগর।  ছবি: প্রথম আলো
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাজশাহী নগর। ছবি: প্রথম আলো
>
  • শহর ছেয়ে আছে নৌকার দুই লাখ পোস্টারে।
  • ধানের শীষ ছেপেছে ৩০ হাজার পোস্টার।

রাজশাহী শহরটা ছেয়ে আছে নৌকার পোস্টার, ব্যানার আর ফেস্টুনে। যেদিকেই ঘাড় ফেরান, শুধুই সরকারি দলের পোস্টার। সড়কের দুই ধারে গাছের মধ্যেও ঝুলছে এগুলো। পুরো শহর ঘুরে বিএনপি প্রার্থীর পোস্টার-ফেস্টুনের দেখা মেলে কালেভদ্রে।

৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী নগরের প্রতিটি মোড়, পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে একই অবস্থা। বিদ্যুৎখুঁটি, সড়ক বিভাজনের বেড়া, ট্রাফিক বা রেল নির্দেশনার খুঁটি, ল্যাম্পপোস্ট-প্রায় সবই আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের দখলে।

রাজশাহী শহরের বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে এমন ‘বিলাসী প্রচারণা’ তাঁরা আগে দেখেননি। নগরবাসীর অনেকেই এটিকে ক্ষমতাসীন দলের শক্তি প্রদর্শন হিসেবে দেখছেন। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলছেন, এটি ‘পোস্টারসন্ত্রাস’।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত শহরের দুটি ‘ডিজিটাল প্রিন্টার’ থেকে খায়রুজ্জামানের ২৮ হাজার ফেস্টুন ও ব্যানার তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি ছাপাখানা থেকে পোস্টার ছাপা হয়েছে অন্তত দুই লাখ। হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারেই খরচ হয়েছে মোট নির্বাচনী ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ। তা ছাড়া ব্যানারের জন্য নির্ধারিত মাপও মানা হয়নি। প্রচারণার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মাইক ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও সরকারি দল তা মানছে না বলে অভিযোগ আছে।

এই বিলাসী প্রচারের দায় নিতে অবশ্য রাজি নন খায়রুজ্জামান। প্রথম আলোকে তিনি গত শুক্রবার বলেছেন, এত ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুন তিনি তৈরি করেননি, করেছেন তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাঁর দাবি, নির্ধারিত মাপের বাইরের পোস্টারগুলো তিনি সরাতে শুরু করেছেন।

১৮ জুলাই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর মতবিনিময়েও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন তখন এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। শাহাদাত হোসেন তাঁর বক্তব্যে আচরণবিধির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ পোস্টার-ব্যানার প্রার্থীকে নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিতে বলেন। নইলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে কী অগ্রগতি হলো, জানতে চাইলে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, ৬০ সেন্টিমিটার বাই ৪৫ সেন্টিমিটারের বেশি মাপের ফেস্টুন-ব্যানার-পোস্টার টাঙানোর অনুমতি নেই। বিষয়টি ১৭ জুলাই চিঠি দিয়ে প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের চিঠির পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। শহরের কুমারপাড়ার যে বাড়ি থেকে ছোট পিকআপে করে খায়রুজ্জামানের নির্বাচনী প্রচারণার ফেস্টুন বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিতরণ করা হয়, গতকালও সেখান থেকে এগুলো নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

নগরের খণ্ডচিত্র
রাজশাহী নগরের কয়েকটি মোড়, সড়ক ও স্থাপনায় খায়রুজ্জামানের ব্যানার ও ফেস্টুনের হিসাব দেখলেই এর তীব্রতা টের পাওয়া সম্ভব। শহীদ কামারুজ্জামান চত্বরে গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে খায়রুজ্জামানের ১২৬টি ফেস্টুন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৫০টি ফেস্টুন সারিবদ্ধভাবে ঘিরে রেখেছে স্মৃতিস্তম্ভকে। এ ছাড়া সারি সারি পোস্টার টাঙানো তো রয়েছেই।

ফেস্টুন গুনতে গুনতে ওই চত্বর থেকে পশ্চিম দিকে এগোতে থাকলে মাত্র ৩০০ মিটার দূরের নগর ভবন মোড় পর্যন্ত ৩৩টি ফেস্টুনের দেখা মেলে। কেবল নগর ভবনের মোড়েই এই সংখ্যা ৩৫। এই মোড় থেকে আরও পশ্চিমে এগোলে ৭০০ মিটার দূরত্বে বর্ণালি মোড় পর্যন্ত ৬৭, সেখান থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বে সিটি বাইপাস মোড় পর্যন্ত ২০৩টি ফেস্টুন রয়েছে।

সিটি বাইপাস মোড়ে এসে অনেকটা থমকে দাঁড়াতে হয়। এই মোড়ের ‘ঐতিহ্য’ নামক ভাস্কর্যটির পুরোটাই ছেয়ে আছে খায়রুজ্জামানের ফেস্টুনে। ভাস্কর্যের চারদিকে চারটি ল্যাম্পপোস্ট। সেগুলোতেও একটি করে ফেস্টুন লাগানো। বাইপাস মোড় থেকে লক্ষ্মীপুর মোড় পর্যন্ত ১৯৮টি ফেস্টুন। শহরের প্রাণকেন্দ্র জিরো পয়েন্ট থেকে ৩০০ মিটার দূরত্বের জাদুঘর মোড় পর্যন্ত খায়রুজ্জামানের ৩১০টি ফেস্টুন দেখা গেল। সেখানে একটি পদচারী-সেতুর পুরোটাই ৬১টি ফেস্টুন দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

জাদুঘর মোড় থেকে অটোরিকশায় করে ফেরার পথে কথা হয় এর চালক ৫৬ বছর বয়সী মতলব আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, একজন প্রার্থীর এত ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার তিনি আগে কখনো দেখেননি।

আ. লীগের হিসাব বনাম বাস্তবতা
খায়রুজ্জামান লিটনের ব্যানার ও ফেস্টুনের নিচে প্রচারে ‘রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অল্প কিছুসংখ্যকের নিচে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা রয়েছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে টাঙানো প্রতিটি ব্যানার ও ফেস্টুনের নিচে মুদ্রণসংখ্যা ৩০০ বলে উল্লেখ করা আছে। আর পোস্টারে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৫০ হাজার। খায়রুজ্জামান তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় ৪০০টি ডিজিটাল ব্যানার ও দেড় লাখ পোস্টারের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ সংখ্যা অনেক বেশি।

খায়রুজ্জামানের ব্যানার ও ফেস্টুনের নিচে নগরের অমিত আর্ট ডিজিটাল সাইন ও প্রজাপতি ডিজিটাল প্রিন্টের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার অমিত আর্টের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়। সব মিলিয়ে খায়রুজ্জামানের ২২ হাজার ফেস্টুন ও ব্যানার তাঁরা বানিয়েছেন। আর প্রজাপতি ডিজিটাল প্রিন্টের প্রতিনিধি জানান ৬ হাজার ফেস্টুনের কথা। রাজশাহীতে পোস্টার লেমিনেটিংয়ের একটিই কারখানা। সেটির মালিকের ভাই জানান, খায়রুজ্জামানের ২ লাখ পোস্টার তাঁরা লেমিনেটিং করেছেন।

বিএনপির প্রচারণার চিত্র
শহর ঘুরে বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেনের ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার চোখে পড়েছে অল্প কিছু। কামারুজ্জামান চত্বর থেকে ১ হাজার ৮০০ মিটার দূরত্বের লক্ষ্মীপুর মোড় পর্যন্ত নৌকার ব্যানার-পোস্টারের সংখ্যা ৬৯৭। আর ধানের শীষের ৩৭।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুন ছাপিয়েছেই কম। তবে তারাও এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত মাপ অনুসরণ করেনি। বিএনপির ব্যানার-ফেস্টুন ছাপানো হয়েছে প্রজাপতি ডিজিটাল প্রিন্ট থেকে। এর ব্যবস্থাপক জানান, বিএনপির প্রার্থী ৭ হাজার ব্যানার-ফেস্টুন ছাপিয়েছেন। আর তাঁর লেমিনেটিং করা পোস্টারের সংখ্যা ৩০ হাজার।

জানতে চাইলে বিএনপির প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পোস্টার লাগাতে গেলে কর্মীদের মেরে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া শহরের কোনো দর্শনীয় জায়গা খালি নেই, যেখানে পোস্টার লাগানো যাবে। সবই আওয়ামী লীগের দখলে।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বিএনপির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের সহমর্মিতা পাওয়ার জন্য তারা এসব বলছে। এখনো শহরে অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে। তারা চাইলেই সেখানে পোস্টার লাগাতে পারে। তারা চাইলে আমরাও সহযোগিতা করব। আসলে তাদের পোস্টার লাগানোর কর্মীই নেই।’

তিন দিন আগে রাজশাহী শহর ঘুরে এসেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। শহর ঘুরে তিনিও সরকারি দলের পোস্টার-ব্যানারের আধিক্য দেখতে পেয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি মোটেই সবার জন্য সমান সুযোগ নয়। এর ব্যর্থতা নির্বাচন কমিশনের। তারা টাকা খরচের পরিমাপটাই শুধু নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেটি মানা হচ্ছে কি না, সে বিষয়টি তদারক করছে না। এ সুযোগে যাঁদের অর্থ আছে, তাঁরা দেদার ঢালছেন। প্রচারণার মাঠ দখল করে নিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মাইকিং করতেও মানা হচ্ছে না নিয়ম
৩০ জুলাই অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে মেয়র পদে ৫ জন এবং কাউন্সিলর পদে ১৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কিন্তু রাস্তায় হাঁটলে খায়রুজ্জামানের পক্ষেই মাইকের আওয়াজ বেশি শোনা যায়। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, মেয়র প্রার্থীরা প্রতিটি ওয়ার্ডের (৩০টি ওয়ার্ড) জন্য একটি করে মাইক ব্যবহার করতে পারবেন।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল নগরের বিডি মাইক থেকে ১৫ টি, নগর ভবনের উল্টো পাশের ইলেকট্রনিকস মাইকের দোকান থেকে ১৯, আলুপট্টি এলাকার বাংলাদেশ মাইক সার্ভিস থেকে ৮, শিরোইল মোল্লা মিল এলাকার খোকন সাউন্ড অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস থেকে ১৫টি মাইক আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর প্রচারণার জন্য ভাড়া নেওয়া হয়।