কাজ ফেলে রাখা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে চায় সরকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

কোনো কাজ ফেলে রাখা এবং কাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধের জন্য সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রচলিত লাল ফিতার ধারণার অবসান ঘটিয়ে সরকারি সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চায় সরকার।

প্রধানমন্ত্রী আজ সোমবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উদ্‌যাপন এবং জনপ্রশাসন পদক-২০১৮ বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকারি সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে সরকারের উন্নয়ন সার্থক হবে। দেশ আরও উন্নত হবে এবং দেশে কোনো দারিদ্র্য থাকবে না।

শেখ হাসিনা তৃণমূল জনগোষ্ঠীর জন্য নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশের উন্নয়নে সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাবেন।’ তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন সরকারি চাকরিতে কাজ করলেও বেতন, কাজ না করলেও বেতন পাওয়া যেত। কাজেই কাজ করলে করলাম বা না করলে নাই—এই চিন্তা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের মনে রাখতে হবে যে দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ থেকে শুরু করে সবার ট্যাক্সের টাকাতেই তাঁদের বেতন হয়। এ জন্য দেশের মানুষের সেবা করার মানসিকতা লালন করতে হবে। তারা যেন অন্তত ভালো থাকে—সেই চিন্তাটা সব সময় মাথায় থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের দিকে দৃষ্টি রেখেই এ চিন্তাটা করার আহ্বান জানাই আমি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মচারীরা যথেষ্ট মেধাবী। মেধা আছে বলেই তাঁরা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাচ্ছেন। কাজেই তাঁদের মেধা, তাঁদের যোগ্যতা, তাঁদের দক্ষতাকে আমাদের দেশ গড়ার কাজে যেমন লাগাতে হবে, তেমনি তাঁদের গুণাবলি ও উদ্ভাবনী শক্তিরও মূল্যায়ন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এসব লক্ষ রেখেই যেমন পদোন্নতি দিয়ে থাকি, তেমনি আজকের যে পুরস্কার বিতরণ, সেটাও সেদিকে লক্ষ রেখেই করে যাচ্ছি।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম এবং জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সরকারি কর্মচারীদের উদ্ভাবনী ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজে উৎসাহ প্রদানের জন্য ২০১৬ সাল থেকে এই পদক চালু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ৩৯ জন ব্যক্তি ও তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জনপ্রশাসন পদক-২০১৮ বিতরণ করেন।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান এবং পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সরকারি পর্যায়েও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২০১২ সাল থেকে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট নামে একটি আলাদা শাখা খোলা হয়েছে। এই ইউনিটের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সরকারি সেবা প্রদান পদ্ধতি সহজ করা। পাশাপাশি সরকারি কাজের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়াই তাঁর সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই এগিয়ে যাওয়ার জন্যই সব সময় উদ্ভাবনী শক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে, যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ হতে পারি। তিনি সরকারি কর্মচারীদের জন্য দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং উচ্চশিক্ষায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রির জন্য আপনাদের অনেক সময় বিদেশ পাঠানো হয়। ডিগ্রি নিজের জন্য নয়, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাবেন। মানুষের জীবনমানের যেন উন্নয়ন হয়, সে কাজে লাগাবেন।

দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিজেদের অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছি। ঢাকায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে, দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি, সারা দেশে বিদ্যুতায়ন করা হচ্ছে এবং দেশব্যাপী ইন্টারনেট সার্ভিস চালু হয়েছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, রাজধানীকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী অতি অল্প সময়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা তাঁর পরিকল্পনায় রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ জন্য বুলেট ট্রেন (দ্রুতগতির ট্রেন) আমরা করতে পারি। আমরা যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-দিনাজপুর ও ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর এবং ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালু করতে পারি, তাহলে সমগ্র দেশের যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত ও দ্রুত হবে। তিনি বলেন, সেই সঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে একটা এলিভেটেড রিং রোড তৈরি করা হবে। নদীগুলো খনন করে নৌপথ তৈরি এবং পাশাপাশি রেলপথ তৈরি করা। এ ছাড়া মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে আবাসনের সৃষ্টি করে নতুন নতুন নগর আমরা গড়ে তুলতে পারি। এভাবে আমাদের দেশটাকে আমরা উন্নত করতে পারি। তিনি বলেন, মানুষ কাজের জন্য দিনে রাজধানীতে এলেও রাতে যেন তারা নিজ শহরে ফিরে যেতে পারে—জনসংখ্যার আধিক্যের কথা মাথায় রেখে সেভাবেই চিন্তা করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি সব সময় মনে করি, আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী নই, জাতির পিতার কন্যা। সেই হিসেবে সবাই আমার পরিবার।’ তিনি বলেন, ‘আপনজন হারিয়ে আমি বাংলাদেশে এসেছি। কাজেই এই দেশটাকে আমি সেভাবেই গড়ে তুলতে চাই, যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল—মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’ ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারায় নানা উন্নয়ন প্রকল্প থেমে গিয়েছিল, এ কথা উল্লেখ করে ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয়, সে জন্য দেশবাসীকে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় পঁচাত্তর–পরবর্তী সরকারগুলোর দুঃশাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের উন্নয়নের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশ অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সব শেষ করে দিয়েছে। এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের ভাগ্য বদলের কাজ করেছে। ফলে দেশের উন্নয়ন হয়নি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশ চালানোর জন্য ভিশন লাগে। লক্ষ্য স্থির করতে হয়। এই লক্ষ্য স্থির করে কাজ করেছি বলে আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে পারছি। আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চাই, সেই লক্ষ্য স্থির করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে। আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন। জনগণ ভোট দিলে আছি, না দিলে নেই। এ জন্য কোনো আক্ষেপ নেই। তবে দেশটাকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছি, তা যেন অব্যাহত থাকে।’