সিলেটে পাল্টে যাচ্ছে ভোটের সমীকরণ

আরিফুল হক চৌধুরী ও বদরউদ্দীন আহমদ কামরান। ফাইল ছবি
আরিফুল হক চৌধুরী ও বদরউদ্দীন আহমদ কামরান। ফাইল ছবি
>

• ‘সংখ্যালঘু’ ও শ্বশুরবাড়ি ফ্যাক্টর
• কামরানকে সমর্থন জাপা ও ইসলামি ঐক্যজোটের একাংশের
• অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনেরাও নির্বাচনে কামরানের পক্ষে মাঠে
• জামায়াত ও ইসলামি আন্দোলনের বাইরে হেফাজতের ভালো প্রভাব

সিলেট সিটি করপোরেশনে কাল ভোট। এরই মধ্যে ভোটের মাঠের নানা সমীকরণ পাল্টে যেতে শুরু করেছে। দল-জোট ও রাজনৈতিক মহলে ভোটের সমীকরণ নিয়ে শেষ মুহূর্তেও নানা হিসাব-নিকাশ চলছে।

ভোট উৎসবের কথা বলা হলেও ভোটারদের চেয়ে প্রার্থী ও দলীয় কর্মীদের মধ্যেই তা বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রার্থীরা ভোটের মাঠে সরব হলেও ভোটাররা যেন নীরব। ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে কথা বলতেও তাঁরা সতর্ক।

সিলেটের রাজনৈতিক মহলের মতে, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সদ্য সাবেক মেয়র বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী ও সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মধ্যে। নির্বাচনের মাঠে নামার পর থেকেই তাঁরা দুজন প্রথমে দলীয় কোন্দল-বিভেদ দূর করা এবং জোটগত ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সফলও হয়েছেন।

রাজনৈতিক মহলের মতে, সিলেট সিটির গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল নিজ দলের একটি অংশের সমর্থন না পাওয়া। কথিত আছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। এবার আর সেই অবস্থা নেই। এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনেরা নির্বাচনে কামরানের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। দলের পক্ষ থেকে পাঁচ মনোনয়ন-প্রত্যাশীও কামরানের পক্ষে মাঠে আছেন। অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে সবাই একসঙ্গে মাঠে আছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, কামরানের নির্বাচনের বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এর মধ্যে আন্তরিকতারও ঘাটতি নেই।

গতকাল শনিবার মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দিয়েছে কামরানকে। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক এ টি ইউ তাজ রহমান এই ঘোষণা দেন। সিলেট সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে এখানে জাতীয় পার্টি কোনো কার্যক্রমে ছিল না। ২০০১ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন গঠনের পর দুই মেয়াদে মেয়র প্রার্থী দিলেও এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোনো মেয়র প্রার্থী দেয়নি।

এদিকে ওই দিন বিকেলে মিজবাউর রহমান চৌধুরী নেতৃত্বাধীন ইসলামি ঐক্যজোট বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, দলটির আরেকাংশ রয়েছে আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে।

বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। দলের ‘উচ্চপর্যায়ের চাপে’ ১৯ জুলাই তিনি আরিফুলের সমর্থনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত তারিখে মনোনয়ন প্রত্যাহার না করায় ব্যালটে তাঁর নাম ও প্রতীক থাকছে। নির্বাচনে আরিফুল হককে সমর্থনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সিলেটের ভোটের মাঠে আর দেখা যাচ্ছে না সেলিমকে।

বদরুজ্জামান সেলিম সমর্থন করলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী এখনো মাঠে আছেন। সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে আছেন। নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীকে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নানা দেনদরবার হলেও তা সফল হয়নি। এটা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনাও রয়েছে। কথিত আছে, সরকারি দলের যোগসাজশে জামায়াত মাঠে রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে এসে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ জামায়াতকে নির্বাচন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। এর জবাবে জামায়াতের প্রার্থী বলেন, ভোটের আগে বিএনপি প্রার্থী সরে দাঁড়াবেন বলে তাঁর আশা।

সিলেটে নিজেদের ভোটব্যাংক প্রসঙ্গে জামায়াত নেতাদের মূল্যায়ন হলো, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলে তাঁদের প্রার্থী ৫০ হাজারের বেশি ভোট পাবেন। আর বিএনপির নেতাদের ধারণা, জামায়াত যা-ই বলুক, দলটির ভোট ১৫ হাজার ছাড়াবে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা, সিলেট শহরে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫ হাজার ভোট রয়েছে জামায়াতের।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সিলেট শহরের পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, দরগাহ মহল্লা, সোবহানীঘাট, মীরাবাজারসহ কিছু এলাকায় জামায়াতের প্রভাব রয়েছে। তবে দলটির বড় ভোটব্যাংক নেই। গত সিটি নির্বাচনে জামায়াতের চারজন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে জয়ী হন। এ অবস্থায় জামায়াত বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর ভোটে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। বরং বিএনপির একটি বড় অংশের বিশ্বাস, জামায়াত না থাকায় তাদের জন্য ভালো হয়েছে। সিলেটের প্রায় এক লাখ সংখ্যালঘু ভোটের একটি বড় অংশ আরিফুলের পক্ষে যাবে বলে তাদের ধারণা। জামায়াত তাদের সঙ্গে থাকলে এই ভোটে প্রভাব পড়ত।

বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের ভোটের দিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের দৃষ্টি রয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বিএনপি ও জামায়াতের ভোট নিয়ে নানা অঙ্ক কষছেন। কারণ, জামায়াত ভালো ভোট পেলে তা বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হকের জন্য ঝুঁকি বাড়বে। এতে সুবিধা হবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের। এ ছাড়া সিলেটে জামায়াতের সঙ্গে কামরানের সুসম্পর্ক রয়েছে—সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন প্রচার রয়েছে।

অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী থাকায় তাদের ভোট অন্যদের বাক্স যাওয়ার সম্ভাবনা কম। 

প্রার্থীদের প্রচারে উৎসবের নগর এখন সিলেট। প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রার্থীদের প্রচারে উৎসবের নগর এখন সিলেট। প্রথম আলো ফাইল ছবি

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনকে বাদ দিলে এখানে হেফাজতের ভালো প্রভাব আছে বলে জানা গেছে। আগের কয়েকটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, আঞ্জুমানে আল ইসলাহ, খেলাফত মজলিশ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতো সংগঠনের মোটামুটি প্রভাব আছে। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে এসব দলের ভোটের ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়। এবারের নির্বাচনেও এসব ভোট বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এসব দলের ভোটারদের কাছে টানতে নেতাদের কাজে লাগাচ্ছেন প্রধান দুই প্রার্থী। সিলেটের পরিচিত ও প্রভাবশালী আলেম ও ইমামদেরও ভোটে কাজে লাগাতে চেষ্টা চালাচ্ছেন কামরান-আরিফুল।

ফ্যাক্টর সংখ্যালঘু ভোট
সিলেটের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশ মনে করে, ভোটের লড়াইয়ে প্রায় এক লাখ সংখ্যালঘু ভোট একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এ বিষয় নিয়ে সচেতন এসব ভোটারও। তাঁরা প্রকাশ্যে কোনো কিছু না বললেও উন্নয়নের দিকে জোর দিচ্ছেন। শহরের মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরী রাজবাড়ী, শিবগঞ্জ, আম্বরখানা, মাছিমপুর মণিপুরীপাড়ায় বিভিন্ন শ্রেণির ‘সংখ্যালঘু’ ভোটারের সঙ্গ কথা বলে জানা গেছে, শ্মশানঘাট উন্নয়ন, মন্দির উন্নয়ন ও জননিরাপত্তার বিষয়ে যিনি অগ্রাধিকার দেবেন, তাঁরা তাঁকে ভোট দেবেন।

শ্বশুরবাড়ি ফ্যাক্টর
এবারের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রায় ৪০-৪৫ হাজার ভোট বড় প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই এসব ভোটারকে নিজেদের পক্ষে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন দুই প্রার্থী। ধারণা করা হচ্ছে, এ ভোট ভাগাভাগি হবে প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই কারণকে ‘শ্বশুরবাড়ি ফ্যাক্টর’ হিসেবে মূল্যায়ন করছেন। কারণ, প্রধান দুই প্রার্থীর শ্বশুরবাড়ি বৃহত্তর এই অঞ্চলে। নিজেদের অঞ্চলের ভোটারদের স্বামীর পক্ষে টানতে সচেষ্ট রয়েছেন দুই প্রার্থীর স্ত্রী।

বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের স্ত্রী আসমা কামরানের বাবার বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ময়তা গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই সিলেটে আছেন। আর আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামা হকের বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের নওমহালে। বিয়ের পর ১৯৯১ সাল থেকে সিলেটেই তাঁর বসবাস। সিলেটের প্রথম দুই নির্বাচনে এই ভোটব্যাংকের দখল ছিল কামরানের হাতে। গত নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী প্রার্থী হয়ে সেই একচ্ছত্র ভোটব্যাংকে ভাগ বসান। এবারও এই ভোটের নিয়ন্ত্রণ নিতে দুই প্রার্থীর স্ত্রী মাঠে রয়েছেন।

ভোটের রাজনীতির বাইরে শঙ্কা 
ভোটের রাজনীতির বাইরে শঙ্কা ভোটের পরিবেশ নিয়ে। ভোটারদের মূল ভয় পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে। ইতিমধ্যে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক মহল। ইতিমধ্যে চারটি মামলায় বিএনপির তিন শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা ঘরবাড়িছাড়া।

আরিফুল হক চৌধুরী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলেছেন। গত শুক্রবার রাতে তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, নির্বাচনের মাঠে যতই চাপ আসুক, হামলা-মামলা ও হুমকি আসুক, মাঠ ছাড়বেন না। দলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা প্রসঙ্গে আরিফুল হক বলেন, ‘সবাইকে এত হয়রানি করছেন কেন। আপনারা বললে আমি সবাইকে নিয়ে কারাগারে হাজির হয়ে যাব।’

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি অতি উৎসাহী মহল কাজ করছে বলে আরিফুল হক মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, সরকারকেও স্যাবোটাজ করার চেষ্টা হচ্ছে। আরিফুল হক বলেন, স্থানীয় এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে জাতীয় নির্বাচনেও তার প্রভাব পড়বে। সেটা দেশের জন্য ভালো হবে না।

এ ধরনের শঙ্কার ভেতরেও মানুষের মধ্যে আশাবাদ রয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কথা বলে বোঝা গেল, সবাই চান শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। সম্প্রীতির শহর সিলেটের সম্প্রীতি নষ্ট হতে দিতে চান না তারা। সাধারণ মানুষ মনে করেন, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এখানে প্রধান যে দুই প্রার্থী তাঁর দুজনই নগরবাসীর পরিচিত। তাঁদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নগরবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত হোক, এটাই চান সবাই।

নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, জনগণই ভোটের প্রধান হিসাব-নিকাশ নির্ধারণ করেন। তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে জনপ্রিয় প্রতিনিধিই নির্বাচিত হয়ে আসবেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।