আ.লীগ-বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের হাতাহাতি, বিচারকের এজলাসের টেবিল ভাঙচুর

আদালত
আদালত

বগুড়ার আদালতে একটি মামলায় আসামিদের জামিন আদেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি এবং বিচারকের এজলাসে হামলা চালিয়ে টেবিল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে এ ঘটনা ঘটে। দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হলে বিচারক দ্রুত এজলাস ত্যাগ করে খাসকামরায় চলে যান। ঘটনার পর আদালতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, বিচারকের এজলাসের টেবিল ভাঙচুর করেছেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এক নেতা। অন্যদিকে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা অভিযোগ করেছেন, বিচারকের এজলাসের টেবিল ভাঙচুরের সঙ্গে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা জড়িত।

আদালত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা আবদুল কাদের, তাঁর বাবা আবদুল আলীম এবং মা শিরিন আকতারের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যৌতুক ও নির্যাতনের মামলা করেন মরিয়ম বেগম নামের একজন নারী। আইনের ১১ (গ)/৩০ ধারায় ১৫ জানুয়ারি দায়ের করা ওই মামলায় নিজেকে আবদুল কাদেরের বিবাহিত স্ত্রী দাবি করেন ওই নারী। তাঁর দাবি, ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক লাখ এক টাকা দেনমোহরে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ঠিকমতো ঘরসংসার করলেও মা-বাবার প্ররোচনায় কাদের তাঁর পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক এনে দিতে অস্বীকার করায় নির্যাতনে সন্তানসম্ভবা ওই নারীর সন্তান নষ্ট হয় বলে অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন কাদের। পরে তিনি শ্বশুরবাড়ি ফিরে এলে বাড়ির লোকজন তাঁকে বেদম মারধর করেন বলে অভিযোগ করেন।

আদালত সূত্র জানায়, মামলার পর প্রাথমিক তদন্তের জন্য প্রথমে নন্দীগ্রাম উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন আদালত। তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুল মোমিন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দেন। সেখানে আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ মিলেছে বলে উল্লেখ করেন।

আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বগুড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতে সোমবার এই মামলায় তিন আসামির জামিন চেয়ে আবেদন করেন তাঁদের আইনজীবীরা। দুপুর ১২টার দিকে শুনানি শুরু হয়। আসামিপক্ষে জামিন শুনানিতে অংশ নেন বগুড়া জেলা আইনজীবী সমিতি এবং বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আতিকুল মাহবুব সালাম। তাঁকে সহযোগিতা করতে আসেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী সমিতির সদস্য খালেকুল ইসলাম।

অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) নরেশ মুখার্জি, সহকারী কৌঁসুলি আশরাফুন নাহার, এইচ আই হাফিজসহ অন্যরা এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নিয়ে জামিনের বিরোধিতা করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সবাই আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের বিরোধিতা করেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে আদালতের বিচারক এ কে এম ফজলুল হক কাঠগড়ায় থাকা আসামিদের এজলাসের সামনে ডেকে নিয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনতে চান। এরপর বিচারক আসামিদের জামিন মঞ্জুরের কথা বলেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি নরেশ মুখার্জি আদালতকে বলেন, আসামি আবদুল কাদের স্ত্রীর সঙ্গে ঘর-সংসার করেছেন। অথচ কাবিননামা করেননি। এতে করে বাদিনীর প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি জামিন পেতে পারেন না। আসামিদের জামিন মঞ্জুর করা হলে বাদিনীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। কিন্তু বিচারক জামিন দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এ নিয়ে বিচারকের সঙ্গে সরকারি কৌঁসুলিরা তর্কে জড়ান। একপর্যায়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের পক্ষ নিয়ে সরকারি কৌঁসুলিদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে বিচারক দ্রুত এজলাস ত্যাগ করে খাসকামরায় চলে যান। উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির পর একপর্যায়ে তা হাতাহাতিতে রূপ নিলে একপর্যায়ে বিচারকের টেবিলের কাচ ভাঙচুর করা হয়।

আদালতকক্ষে হাতাহাতি, হট্টগোলের কথা উভয় পক্ষের আইনজীবীরা স্বীকার করেছেন। তবে বিচারকের টেবিল ভাঙচুরের জন্য তাঁরা পরস্পরকে দায়ী করছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নরেশ মুখার্জি অভিযোগ করেন, ‘জামিন-অযোগ্য ধারায় দায়ের হওয়া এই মামলার তদন্তে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। চিকিৎসকদের দেওয়া সনদেও নির্যাতনের প্রমাণ মিলেছে। অথচ বিচারক জামিন-অযোগ্য এই মামলায় আসামিদের জামিন দিয়েছেন। আদালতে শুনানির সময় বিচারক প্রথা ভেঙে আসামিদের কাঠগড়া থেকে এজলাসের সামনে ডেকে নিয়েছেন। একজন আসামি বোরকা পরে ও মুখ ঢেকে আদালতে আসেন। তিনি প্রকৃত আসামি কি না, সন্দিহান ছিলাম। আমরা বিষয়টি আদালতের নজরে আনলেও আদালত আমলে নেননি। উল্টো লিখিত আদেশ দেওয়ার আগে আদালত শুনানির সময়ই জামিন মঞ্জুরের কথা বলে এজলাস ত্যাগ করেন। আমরা যুক্তিতর্ক দিয়ে এই জামিনের বিরোধিতা করেছি।’

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য নরেশ মুখার্জি আরও বলেন, ‘জামিনের বিরোধিতা করায় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে শিষ্টাচার ভেঙে উসকানিমূলক আক্রমণ করেন। এ সময় বাগবিতণ্ডা ও হট্টগোল হয়েছে। আমরা এজলাস ত্যাগ করার পর শুনেছি সেখানে বিচারকের টেবিল ভাঙচুর হয়েছে। আমরা সরকারি দলের রাজনীতি করি। বিচারকের বিরুদ্ধে নালিশ থাকলে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে করব। বিচারকের এজলাস সরকারের সম্পদ। সেই সম্পদ আমরা ভাঙচুর করব কোন দুঃখে? ভাঙচুর বিএনপির স্বভাব। এটা বিএনপির আইনজীবীরাই করেছেন।’

অন্যদিকে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আতিকুল মাহবুব ঘটনার পরপরই তাঁর মুঠোফোন বন্ধ করে আদালত চত্বর ত্যাগ করেন। তাঁর সহযোগী আইনজীবীদেরও আদালত চত্বরে দেখা মেলেনি।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আতিকুল মাহবুব ফোন বন্ধ রেখেছেন। তবে তিনি (মাহবুব) আমাকে জানিয়েছেন, বিচারক জামিন মঞ্জুর করায় আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতা নরেশ মুখার্জি উত্তেজিত হয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ‘দালাল’ বলে মন্তব্য করেন। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে হট্টগোল শুরু হলে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে বিচারকের টেবিলের কাচ ভাঙচুর করেন।

বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট আদালতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।