মুখে স্বাগত জানালেও দুশ্চিন্তায় আ.লীগ

>
  • বৃহত্তর ঐক্য হলে কোণঠাসা বিএনপি সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে 
  • সরকারবিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ জোট করা কঠিন মনে করে আ.লীগ
  • সরকারের পক্ষ থেকে নানা চাপ-প্রলোভন থাকবে
  • জামায়াতকে কৌশলে সঙ্গে রাখা নিয়ে শঙ্কা সরকারি দলে
  • আ. লীগ নিজেদের জোট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে

বিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়াকে মুখে স্বাগত জানালেও ভেতরে-ভেতরে দুশ্চিন্তা আছে আওয়ামী লীগের। বিশেষ করে, এই জোটে বিএনপির অন্তর্ভুক্তির তৎপরতা দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে কোণঠাসা বিএনপি সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বৃহত্তর ঐক্যের যে তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ বেশ সতর্ক। বিশেষ করে, ঐক্যে বিএনপির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রভাব কতটা পড়বে, এটা নিয়েই তাদের মূল চিন্তা। আর জামায়াতে ইসলামীকে বাদ না দিয়ে কৌশলে সঙ্গে রাখা হচ্ছে কি না, এটাও সরকারি দলের ভাবনায় আছে।

সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই একটা ধারণা বিদ্যমান যে বিএনপি ভাঙবে। বিশেষ করে, দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে তাঁর দলে ভাঙন নিশ্চিত। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করতে পারে এবং এর ফলে দলটিতে ভাঙন ধরবে—এমন ধারণাও প্রবল। কিন্তু গত আট মাসে সে রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বৃহত্তর ঐক্যের নামে যে তৎপরতা চলছে, তাতে বিএনপির অন্তর্ভুক্তি দলটির ভাঙন ঠেকিয়ে দেবে বলেই মনে করছেন সরকারি জোটের নেতারা। শুধু তা-ই নয়, এর মাধ্যমে বিএনপি নতুন শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। শেষমেশ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানই জোটের মূল প্রভাবক হয়ে উঠতে পারেন, এমন আলোচনাও আছে সরকারি মহলে। এ ছাড়া জামায়াতকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের যে কথা বলা হচ্ছে, আদতে তা হবে না। নেপথ্যে জামায়াত সরকারবিরোধী জোটে থেকেই যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালে বিমসটেক সম্মেলনে অংশ নিয়ে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কামাল হোসেনসহ অন্য নেতাদের ঐক্য-প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কর্তৃত্বহীন এবং জামায়াতমুক্ত জোট হলেও সরকার এই জোটকে রাজনৈতিকভাবে ছাড় দেওয়ার পক্ষে নয়।

আওয়ামী লীগের একজন উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখনো মনে করেন, সরকারবিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো জোট গঠন করতে পারবেন না। আর সরকারের পক্ষ থেকে নানা চাপ-প্রলোভন তো থাকবে। সরকার একদিকে জোটে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে, অন্যদিকে নিজেদের জোট সম্প্রসারণ ও নতুন দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা চালাবে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ইতিমধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদও আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। ধর্মভিত্তিক দল ইসলামিক ফ্রন্ট ১৭ সেপ্টেম্বর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি জোটে থাকার ঘোষণা দেবে বলে জানা গেছে। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বিএনএ জোটের প্রধান নাজমুল হুদাও আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গেও সরকারের যোগাযোগ আছে। জাকের পার্টিকেও সরকারি জোটভুক্ত করার জোর তৎপরতা আছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতৃত্বাধীন আট দলের জোটকেও কাছে টানতে চায় আওয়ামী লীগ। এটা সম্ভব না হলে তারা যাতে বিরোধী জোটে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে চায়।

দশম সংসদের ‘একতরফা’ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ঢাকা-১৭ আসনের সাংসদ হন বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ। তিনিও সরকারের সঙ্গেই থাকার কথা বলছেন। ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সরকারি জোটের অংশ হয়েই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং এর জোটসঙ্গীদের মধ্যে দুই ধরনের ভাবনা আছে। একটি অংশ মনে করছে, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, জঙ্গিবাদের উত্থান এই জোটের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করেছে। এই অবস্থায় আরেকবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের জন্য যেনতেনভাবে ২০১৪ সালের মতো একটা নির্বাচন হলে বড় কোনো ক্ষতি হবে না। আর মানুষের মনে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে যে বিএনপির পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই মানুষ মেনেই নিয়েছে, আরেকবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে।

আরেকটি অংশ মনে করছে, ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করা কঠিন। দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা ক্ষুব্ধ করেছে। ফলে যেনতেন নির্বাচন করা কঠিন হবে। এই অবস্থায় খালেদা জিয়া ও তারেকবিহীন সরকারবিরোধী জোটকে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন হতেই পারে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না বিএনপি, আর জামায়াতও বিএনপিকে ছেড়ে যাবে না। আবার যেসব নেতা বৃহত্তর ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদের ব্যক্তি পরিচিতি থাকলেও জনসমর্থন নেই। ফলে তাঁদের মধ্যে একটা ঐক্য হলেও সেটা আদর্শিক নয়, স্বার্থকেন্দ্রিক হবে।