বাংলাদেশের শিশুদের কানের সমস্যা বেশি

  • গবেষণাটি করেছে গ্লোবাল রিসার্চ অন ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি কলাবরেশন
  • গবেষণা প্রবন্ধটি গত ২৯ আগস্ট ল্যানসেট-এর অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয়েছে
  • গবেষকেরা ১৯৯০-২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন
  • গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, শিশুদের প্রতিবন্ধিতার বিষয়ে তথ্য পাওয়া দুষ্কর
  • গবেষণা প্রবন্ধে জনসংখ্যার হিসাবে শিশুদের ছয়টি রোগের তালিকা আছে

বাংলাদেশের শিশুদের কানের সমস্যা বিশ্বের যেকোনো দেশের শিশুদের চেয়ে বেশি। বৈশ্বিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি লাখ শিশুর মধ্যে ৪ হাজার ৭৪২ জন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী বা তারা কোনো না কোনো ধরনের কানের সমস্যায় আক্রান্ত। এই হার বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত ১৯৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় গবেষণাটি করেছে গ্লোবাল রিসার্চ অন ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি কলাবরেশন নামের প্রতিবন্ধিতা-বিষয়ক গবেষণার একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ। গবেষণা প্রবন্ধটি গত ২৯ আগস্ট যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা ও গবেষণা সাময়িকী ল্যানসেট-এর অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয়েছে।

গবেষকেরা ছয় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর আধিক্যের ভিত্তিতে শীর্ষ ১০টি দেশের আলাদা ছয়টি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এগুলো হলো শ্রবণপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, অটিজম, মৃগী রোগী ও মনোযোগহীন অতিচঞ্চলতা (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার-এডিএইচডি)। এর মধ্যে শ্রবণ সমস্যা, মৃগী রোগ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও অটিজমের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে।

ল্যানসেটের পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মাহামুদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় বধিরতায় ভুগছে। এদের মধ্যে শিশুরাও আছে। কানের সমস্যা আছে এমন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪০ শতাংশের জন্মগতভাবে কানে সমস্যা থাকে, ১৮ শতাংশ সমস্যা হয় সংক্রমণের কারণে, ৮ শতাংশের সমস্যা হয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। বাকিদের সমস্যার পেছনে রয়েছে কান খোঁচাখুঁচিসহ আরও বেশ কিছু কারণ।

গবেষকেরা ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, শিশুদের প্রতিবন্ধিতার বিষয়ে তথ্য পাওয়া দুষ্কর। সরকারি একাধিক দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশেও এমন সমস্যা নিয়ে জাতীয় কোনো জরিপ নেই। তবে গবেষণা প্রবন্ধের সংযোজনীতে দেখা যায়, ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, তানজানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে জরিপ হয়েছিল। সেই তথ্য এই গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের অনুমিত পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬২৯ জন। প্রতি লাখ শিশুর মধ্যে ৪ হাজার ৭৪২ জন কানের কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে। আনুপাতিক হারে এটাই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। তবে মোট জনসংখ্যার হিসাবে শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ভারতে। এই তালিকার পাঁচ নম্বরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওপরে থাকা অন্য দেশগুলো হচ্ছে চীন, নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান।

নাক, কান ও গলার রোগ বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, গর্ভাবস্থায় মা অপুষ্টিতে ভুগলে, গর্ভাবস্থায় সেবন করা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শিশু কানের সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। জন্মের পর হামজাতীয় রোগও কানের সমস্যার কারণ। শিশুর কানে পানি ঢুকে বা অন্য কারণে কান পাকার পর ঠিক চিকিৎসা না হলে কানের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কানে বিশেষ ধরনের টিউমার হয়।

গবেষণা প্রবন্ধে জনসংখ্যার হিসাবে শিশুদের ছয়টি রোগের তালিকা আছে। এতে মৃগী রোগ সবচেয়ে বেশি ভারতে। এই তালিকার ৯ নম্বরে বাংলাদেশ। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর তালিকার শীর্ষেও ভারত। ওই তালিকার ১০ নম্বরে বাংলাদেশ। তবে এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র আছে বাংলাদেশের দুই ধাপ ওপরে। অটিজমের তালিকায় বাংলাদেশ ৯ নম্বরে। এই তালিকায়ও ভারত সবার ওপরে। এডিএইচডি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর তালিকার শীর্ষে ভারত।

২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৫ কোটি ২৯ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ। উত্তর আমেরিকার দেশগুলো ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা কমেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশের বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। প্রতিবন্ধিতা মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে বেশি। শিশুরা বেশি আক্রান্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতায়।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ১৯৯০ সালে মোট প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ১২৯। ২০১৬ সালে সংখ্যা কমে হয় ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৯। সংখ্যা কমে আসার কোনো কারণ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়নি। তবে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি কমানোর কিছু উদ্যোগ বাংলাদেশ ও ভারতে আছে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রথম পাঁচ বছর জীবনের সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি ও মস্তিষ্ক গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা জীবনের শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের ভিত্তি তৈরি করে। প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি থাকে। তারা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে এবং সার্বিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি থেকে তারা দূরে থাকে।

শিশুদের জন্মগত ত্রুটি ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দেড় দশকের বেশি সময় গবেষণা করছেন চিটাগং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন সার্জারির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা বানু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মায়ের অপুষ্টিসহ গর্ভাবস্থায় নানা সমস্যার কারণে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে শিশু জন্মাতে পারে। জন্মের পর পারিপার্শ্বিক কারণেও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। অনেক দেশে জন্মের সাত দিন পর ও ছয় সপ্তাহে সমস্যা শনাক্ত করার ‘বার্থ স্ক্রিনিং’ নামে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। বাংলাদেশে পদ্ধতিটি চালু করলে প্রতিটি শিশুর অবস্থা জানা যাবে এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো।