বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পাঠানোই পুনর্বাসন!

সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরছেন নারী গৃহকর্মীরা। ফাইল ছবি
সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরছেন নারী গৃহকর্মীরা। ফাইল ছবি

সৌদি আরব থেকে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারী গৃহকর্মীদের জন্য সরকারের কোনো পুনর্বাসন কার্যক্রম নেই। বিমানবন্দরে নেমে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের কাছে কোনো নারী নির্যাতনের কথা জানালে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো বা বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এর বাইরে তাঁদের জন্য সরকারের আর কোনো উদ্যোগ নেই।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বলেন, সৌদিফেরত নারীদের জন্য এই মুহূর্তে কোনো পুনর্বাসন কার্যক্রম সরকারের নেই। তবে কেউ চাইলে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ৪২ নারী গৃহকর্মী। তাঁদের মধ্যে একজনের বাড়ি মানিকগঞ্জে। সাত মাসের বেশি সময় দেশটিতে ছিলেন। তিনি বলেন, সেখানে খাওয়ার কষ্টের পাশাপাশি কাজের চাপও অনেক ছিল। শেষ দুই মাসের বেতন পাননি তিনি।

এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব থেকে একসঙ্গে ফিরেছেন ৬৫ জন নারী শ্রমিক। তাঁদের একজন সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। যে বাড়িতে তিনি কাজ করতেন, সেই বাড়ির মালিক তাঁকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করেন। দেশে ফেরার পর ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির পক্ষ থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীদের সার্বিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকলে তাঁদের সুস্থ করে তোলা কঠিন হয়ে পড়বে।

১৩ সেপ্টেম্বর ফেরত আসা আরেক নারী জানান, বিদেশে যাওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ভাগ্য ফেরাতে তিনি সৌদি আরব যান। সেখানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে তাঁর ওপর। দুই বছর সেখানে ছিলেন। শেষ দুই মাসের বেতন তাঁকে দেননি সৌদি মালিক। যে দালালের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরবে গেছেন, সেই দালাল এখন তাঁর কাছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাবি করে বারবার হুমকি দিচ্ছেন। তাঁকে সৌদি আরবে পাঠানো এবং দেশে রেখে যাওয়া মেয়ের জন্য খরচ করা বাবদ ওই টাকা দাবি করেছেন দালাল।

বিদেশে গৃহকর্মীর কাজে গিয়ে নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন, এ ধরনের উদাহরণ খুব কম বলে জানান বাংলাদেশ মহিলা অভিবাসী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীদের অনেকে পরিবারের কাছে যেতে চান না, আবার অনেককে পরিবার নিতে চায় না।

ফেরত আসা নারীদের আর্থিক সহায়তা, বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করানো, সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের। এই সংস্থার অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জানান, গুরুতর নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা ২২ জন নারীকে ব্র্যাক এবং লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ যৌথভাবে ১ লাখ টাকা করে দিয়েছে। এ ছাড়া ফেরত আসা ৫০ জন নারীকে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন সংস্থা ২০১০ সাল থেকে পাচারের শিকার এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের জন্য রাজধানীতে একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করছে। কিন্তু এখানে মাত্র ছয়জন নারীর থাকার ব্যবস্থা আছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবে ১০০ জন পুরুষ কর্মী পাঠালে যে লাভ হয়, ২০ জন নারী কর্মী পাঠালে তার সমান লাভ হয়। সৌদি মালিক ১ হাজার ৭০০ ডলার অগ্রিম দিয়ে গৃহকর্মীদের কাজের জন্য নিচ্ছেন। কোনো কারণে এই নারীদের ফেরত আসতে হলে তাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নিতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।