এবার ওষুধের ডালি নিয়ে সাইফুল

অজ্ঞাত রোগীদের ওষুধপত্র গুছিয়ে রাখছেন সাইফুল ইসলাম। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তোলা।  প্রথম আলো
অজ্ঞাত রোগীদের ওষুধপত্র গুছিয়ে রাখছেন সাইফুল ইসলাম। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তোলা। প্রথম আলো

স্বজনহীন অজ্ঞাত রোগীদের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু হচ্ছে নতুন ধরনের সেবা। বিভিন্ন ওয়ার্ডে জরুরি ওষুধ, অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম ও পরিধেয়-সামগ্রীর একটি শোকেস থাকবে। চিকিৎসকেরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে পরিচয়হীন রোগীদের চিকিৎসা করবেন।

একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে হচ্ছে এই অনন্য আয়োজন। পাঁচ বছর ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অজ্ঞাত রোগীদের সেবা দিয়ে আসছেন সাইফুল ইসলাম ওরফে নেছার নামের এক যুবক। ব্যক্তিগত সেই উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছেন এবার। এ কাজে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় কয়েকটি সংগঠন।

দুর্ঘটনায় আহত হয়ে, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে স্বজন ছাড়া হাসপাতালে এলে চিকিৎসা পাওয়া দুরুহ হয়ে পড়ে। তাদের জরুরি ওষুধপথ্য কিনে দেওয়ার কেউ থাকে না। অস্ত্রোপচারের দরকার হলে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। দ্রুত চিকিৎসা না পেলে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে।

বেশ কয়েক বছর হলো সাইফুল চমেক হাসপাতালের অজ্ঞাত রোগীদের সেবা দেওয়া শুরু করেন। তিনি নিজের পকেটের টাকায় বা পৃষ্ঠপোষক জোগাড় করে এ কাজ করে আসছেন। চিকিৎসা শেষে ঠিকানা বের করে অনেককে বাড়ি পৌঁছে দেন। শিপিং কোম্পানির কর্মী সাইফুল আগে নিজের কাজ সেরে হাসপাতাল এসে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে অজ্ঞাত রোগী খুঁজে বের করে তাঁদের সেবা করতেন। এখন অজ্ঞাত রোগী ভর্তি হলে সাইফুলকে খবর দেয় হাসপাতাল প্রশাসন। সাইফুলের এই অনন্য কাজ নিয়ে ২০১৬ সালে প্রথম আলো একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রচার করে।

সাইফুলের নতুন উদ্যোগ ফলপ্রসূ হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ধরনের সেবা একটা ভিন্নমাত্রা পাবে। অন্য সরকারি হাসপাতালেও এমন উদ্যোগ নেওয়া যাবে।

জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে স্বজন পাওয়া না গেলে অজ্ঞাত রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। রোগী অজ্ঞান কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে স্বজনদেরও পাওয়া যায় না। এসব মাথায় রেখে রোটারি ক্লাবসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় অজ্ঞাত রোগীদের জন্য হাসপাতালে জরুরি ওষুধসহ অন্যান্য জিনিসের একটি শেলফ (তাক) রাখা হচ্ছে।

প্রথমে হাসপাতালের ২৮ নম্বর নিউরো সার্জারি বিভাগে এই শোকেস রাখা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। পর্যায়ক্রমে অর্থোপেডিক, সার্জারি ও মানসিক রোগ বিভাগেও এই ব্যবস্থা চালু হবে।

হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক হুমায়ুন রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সরবরাহ না থাকলে অজ্ঞাত রোগীদের ওষুধপথ্য জোগাড় করতে সমস্যায় পড়তে হয়। তখন সাইফুলের সহযোগিতা নিতে হতো। নতুন এ ব্যবস্থার ফলে এখন আর কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, নিউরো সার্জারি বিভাগের একটি কক্ষে একটি কাচের শোকেস। তাতে লেখা, ‘এই শোকেসে সংরক্ষিত ওষুধ ও যাবতীয় সরঞ্জাম শুধু অজ্ঞাত রোগীদের জন্য।’ ওপরে একটি লাল রঙের বাঁধাই করা খাতা। ওষুধ নিয়ে ওই খাতায় নিবন্ধন করতে হবে। অজ্ঞাত রোগী এলে কাপড়চোপড়ও দরকার হয়। সে কারণে পরিধেয় বস্ত্রও রাখা হয়েছে শোকেসে। তালাবদ্ধ এই শোকেসের চাবি থাকে চিকিৎসকের কাছে। ওষুধপথ্য শেষ হয়ে এলে তা আবার কিনে এনে রাখা হবে।

এই শোকেস সেবা চালু করতে রোটারি ক্লাব অব মেট্রোপলিটন চট্টগ্রাম, জুলফার বাংলাদেশ, পোর্টল্যান্ড গ্রুপ এবং কুইক এনার্জি নামের প্রতিষ্ঠান সাইফুলকে সহযোগিতা দিয়েছে। সাইফুল ইসলাম ফেনীর ছাগলনাইয়ার বাসিন্দা। ২০০৭ সালে তাঁর বাবা শামসুল হক অনেকটা চিকিৎসার অভাবে চমেক হাসপাতালে মারা যান। তারপর থেকে সাইফুল অজ্ঞাত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন।

চট্টগ্রামের মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও অজ্ঞাত রোগীদের জন্য এই ধরনের সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে জানান সাইফুল।

যত অজ্ঞাত রোগী
২০১৬ সালে চমেক হাসপাতালে ৯৩ জন অজ্ঞাত রোগী ভর্তি হয়। এর মধ্যে ১৭ জন মারা যায়। বাকিরা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে। পরের বছর ৫৭ জন অজ্ঞাত রোগীর মধ্যে ৯ জন মারা যায়। ১৬ জন স্বজন খুঁজে পায়। চলতি বছর এই পর্যন্ত ২৭ জন অজ্ঞাত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে হাসপাতালটিতে।

নুরুজ্জামান নামের এক যুবক গত রোববার স্বজনদের খুঁজে পান। তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গত ২৭ আগস্ট ভর্তি হয়েছিলেন। সাইফুলই তাঁর ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। নুরুজ্জামানের স্বজনেরা হাসপাতাল ছাড়ার সময় সাইফুলের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানান।

অজ্ঞাত রোগী ভর্তি হলেই সাইফুল মুঠোফোনে ছবি তুলে তা তাঁর ওয়েবসাইটে (www.mdnasar.org) দিয়ে দেন। এই ওয়েবসাইটে এখন অনেকে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের খোঁজেন। কেউ কেউ খুঁজেও পান।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয় সাইফুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অজ্ঞাত রোগীদের অসহায় মুখগুলো আমাকে কষ্ট দেয়। তাই নিজের সবকিছু দিয়ে দিই। মাস শেষে নিজেরই চলতে কষ্ট হয়। কিন্তু যখন অজ্ঞাত কোনো রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন সবকিছু ভুলে যাই।’