সিরাজগঞ্জে বেকায়দায় আ.লীগ, বিএনপিতে স্বস্তি

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আসন–সিরাজগঞ্জ ১, আ.লীগ
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আসন–সিরাজগঞ্জ ১, আ.লীগ

সিরাজগঞ্জে আসনসংখ্যা ছয়টি। অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। শরিক দলের তেমন কোনো জোরালো প্রার্থী না থাকলেও, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কারণে দলটি বেশ চাপের মুখেই রয়েছে। অন্যদিকে তিনটি আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেশি হলেও, দ্বন্দ্ব না থাকায় দলটি বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর-সদরের আংশিক) আসনে মোহাম্মদ নাসিম এবং সিরাজগঞ্জ-২ (কামারখন্দ-সদরের আংশিক) আসনে হাবিবে মিল্লাত একক প্রার্থী হিসেবেই রয়েছেন। বাকি চারটি আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে এবং মনোনয়ন প্রত্যাশী বেশি থাকায় জটের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির প্রচারণা তেমন না থাকলেও, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দল না থাকায় দলটি স্বস্তিতে আছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস বলেন, ‘বড় দলে একাধিক প্রার্থী থাকতেই পারে। তবে দলীয় কোন্দল কিছুটা থাকলেও, এর বহিঃপ্রকাশ নেই। ছয়টি আসনেই নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে পরিকল্পনামাফিক নেতা-কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন।’

গত ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একটি আসনে (সিরাজগঞ্জ-২) জয়ী হয়েছিল। বাকি পাঁচটি আসনেই আওয়ামী লীগ জিতেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনে নির্বাচন হয়েছে। বাকি পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়।

আওয়ামী লীগ
সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর-সদরের আংশিক): এই আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো কোন্দল নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও আসনে একক প্রার্থী হিসেবে আছেন। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে বলেই সবার ধারণা।

সিরাজগঞ্জ-২ (কামারখন্দ-সদর আংশিক): এ আসনে বর্তমান সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাবিবে মিল্লাত একক প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি অনেক আগে থেকেই মাঠে আছেন। তবে শরিক দলের মধ্যে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আমিনুল ইসলাম মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে তিনি এখনো পর্যন্ত প্রচারণা শুরু করেননি।

নাজমুল হাসান খান রানা, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি
নাজমুল হাসান খান রানা, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি



সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ-তাড়াশ): এ আসনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বর্তমানে সংসদ সদস্য ম. ম. আমজাদ হোসেন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হকের মধ্যে তীব্র কোন্দল রয়েছে। এ ছাড়া রায়গঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও সঙ্গেও রয়েছে দূরত্ব। ফলে এই আসনে দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই দুজনের পাশাপাশি রায়গঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হাদী আলমাজী, প্রয়াত সাংসদ ইসহাক হোসেন তালুকদারের ছেলে ইমন তালুকদার, স্বাচিপ নেতা ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল আজিজ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. লুৎফর রহমান, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আব্দুল লতিফ এবং শাখাওয়াত হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন। তবে এ আসনে সাংসদ আমজাদ হোসেনের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আলোচিত। এ কারণে আসনটি ধরে রাখতে মোহাম্মদ নাসিমকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলেও দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া): এ আসনে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক সাংসদ মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বর্তমান সাংসদ তানভীর ইমামের রয়েছে প্রকাশ্য বিরোধ। মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় আরও আছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল হক, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মারুফ-বিন-হাবিব এবং প্রয়াত সাংসদ আব্দুল লতিফ মির্জার কন্যা সেলিনা মির্জা। এরা সবাই দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে সরব রয়েছেন।

এ আসনে জামায়াতের ভিত ভালো থাকায় দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান প্রার্থী হচ্ছেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন বলে এলাকায় প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী): এ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সঙ্গে বর্তমান সাংসদ আব্দুল মজিদ মন্ডলের দন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দুজনই মনোনয়ন প্রত্যাশী। স্বাস্থ্যগত কারণে মজিদ মন্ডল রাজনীতি থেকে কিছুটা দুরে আছেন। তবে তাঁর ছেলে ও মন্ডল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিন মন্ডল, কেন্দ্রীয় যুবলীগের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মুশফিকুর রহমান, ঢাকা বনানী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন, বেলকুচি উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, সিরাজগঞ্জ জেলা জজ আদালতের পিপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুর রহমান মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন।

রহমাতুল্লাহ আইয়ুব, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি
রহমাতুল্লাহ আইয়ুব, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি

সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর): উপজেলায় আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত। বর্তমান সাংসদ হাসিবুর রহমান, সাবেক সাংসদ চয়ন ইসলাম ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল হামিদ ত্রিমুখী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলীয় নেতা-কর্মীরাও প্রকাশ্যে বিভিন্ন পক্ষের প্রচারে নেমে পড়েছেন। এঁদের সঙ্গে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা সাজ্জাদুল হায়দার।

বিএনপি
নানামুখী চাপ ও মামলার কারণে সিরাজগঞ্জে বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকলেও, গত এক মাস ধরে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে নামতে শুরু করেছেন। তবে প্রতিটি আসনেই একাধিক প্রার্থী কাজ করছেন। প্রচারণা শুরু হলেও, তা চলছে হাঁকডাক ছাড়াই।

গত দুই নির্বাচনে বিএনপি সিরাজগঞ্জে ভালো ফল না পেলেও, এর আগে এই অঞ্চলে দলটির অবস্থান দৃঢ় ছিল। অতীত বিবেচনায় এনে এবার দলটি আসন পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায়, প্রকাশ্যে প্রচারণায় নামতে পারছেন না।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের আগের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি বেশির ভাগ আসনে জয়ী হয়েছিল। তখন থেকেই জেলাটি বিএনপি অধ্যুষিত বলে পরিচিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সেই বিএনপি মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করে। বর্তমানে দলটি আসন পুনরুদ্ধারের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে অধিকাংশ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, দলটি কিছু জটিলতার মধ্যে আছে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ ভোটাররা বিএনপির পক্ষে রয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ না থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ক্ষমতাসীন দলের চাপের মুখে মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছে না। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা বেশি থাকলেও, দলের স্বার্থে সবাই একমত হয়ে একজনকেই সমর্থন দেবে। নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত আছেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে বিএনপি এ জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে।’

সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর-সদরের আংশিক): এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি সেলিম আহমেদ, জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজমুল হাসান, রহমতুল্লাহ আইয়ুব ও বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী কনক চাঁপা। 

সেলিম জাহাঙ্গীর, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি
সেলিম জাহাঙ্গীর, আসন-সিরাজগঞ্জ ১, বিএনপি

সিরাজগঞ্জ-২ (কামারখন্দ-সদর আংশিক): এ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ একক প্রার্থী বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন। তবে বিশেষ কারণে তাঁর স্ত্রী ও সাবেক সাংসদ রোমানা মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মোহাম্মদ হানিফ মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ-তাড়াশ): এখানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বিএনপির প্রবীণ নেতা ও সাবেক সাংসদ আব্দুল মান্নান তালুকদার, তাড়াশ উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার সেলিম জাহাঙ্গীর, কেন্দ্রীয় বিএনপির গ্রাম সরকার বিষয়ক সহসম্পাদক সাইফুল ইসলাম এবং রায়গঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও যুবদলের সভাপতি আইনুল হক মনোনয়নের প্রত্যাশায় করছেন।
সিরাজগঞ্জ-৪(উল্লাপাড়া): এ আসনে থানা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে চরম কোন্দল। দীর্ঘদিন ধরে নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। সাবেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য এম আকবর আলী এবং বর্তমান থানা বিএনপির আহ্বায়ক কাজী কামালের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এঁদের পাশাপাশি জেলা বিএনপির সদস্য শরাফত উদ্দীন, কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য আব্দুল ওয়াহাব, সাবেক সাংসদ শামছুল আলম, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক সিমকী ইমাম খান মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন।
এ আসনে জামায়াতের ভিত বেশ ভালো থাকায় জামায়াতে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান প্রার্থী হচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী): এ আসনেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল আছে। মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন চৌহালী উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আব্দুল্লাহ আল মামুন, জেলা বিএনপির সদস্য বাবলু খান, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সহ প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি রকিবুল করিম খান।
সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর): এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে সব প্রার্থীই মনোনয়ন পেতে এবং জনসমর্থন আদায়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল মতিনের ছেলে ও জেলা বিএনপির সদস্য এম এ মুহিত, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ, সাবেক সচিব ও বিএনপির কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সদস্য খান এম ইব্রাহীম হোসেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি হুসাইন শহীদ মাহমুদ, পৌর বিএনপির সভাপতি মো. তরিকুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মো. গোলাম সরোয়ার এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা মো. শফিকুল ইসলাম মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে সক্রিয় আছেন।