ব্যাংকারের ব্যক্তি উদ্যোগ এখন সরকারের

অগ্রণী ব্যাংকে প্রধান কার্যালয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু কর্নার। ছবি: আব্দুস সালাম
অগ্রণী ব্যাংকে প্রধান কার্যালয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু কর্নার। ছবি: আব্দুস সালাম

অফিসটিতে ঢুকতেই সবার চোখ আটকে যায় কর্নারটিতে। বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা আছে সেখানে। কক্ষটির শেলফে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো বই। একটি বড় ছবির নিচে লেখা ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি বঙ্গে/এইখানে কিছুক্ষণ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে’। অফিসে আসা মানুষজন সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে প্রবেশ করেন কর্নারটিতে। যাঁরা অপেক্ষা করেন, তাঁরা বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। কেউ বা মোবাইলে সেখানকার সুন্দর দৃশ্যগুলো ধারণ করেন।

অফিসটির অবস্থান রাজধানীর দিলকুশা এলাকায়। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। অগ্রণী ব্যাংক ভবনের সপ্তম তলায় চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয় এবং বোর্ড রুমের পাশেই এ কর্নার। নাম দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে বঙ্গবন্ধুর যে আবক্ষ ভাস্কর্য রয়েছে তার ওজন ১১৭ কেজি। বঙ্গবন্ধু–সম্পর্কিত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বই-পুস্তক, ছবি, লেখা ও প্রামাণ্যচিত্র স্থান পেয়েছে কর্নারে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রায় ৪০০ বই রয়েছে সেখানে, যেগুলো বঙ্গবন্ধুর জীবন–কর্মসহ দেশের সুস্পষ্ট ইতিহাস পাঠককে তথ্য দিতে যেন অপেক্ষা করছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুসংশ্লিষ্ট তিনটি ছবির অ্যালবাম, যাতে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় অনেক ছবি। বঙ্গবন্ধুর ছবি–সংবলিত ৫ ও ১০ টাকার দুটি বড় নোটও রাখা আছে।

কর্নারটি তৈরি করার উদ্যোগ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলামের। কর্নারটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা না হলেও পুরোপুরি প্রস্তুত। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমতি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের হাতে এর উদ্বোধন করা হবে। তবে, ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল সেখানে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ মূর্তিটি উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

অগ্রণী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু কর্নারে দর্শনার্থীরা। ছবি: আব্দুস সালাম
অগ্রণী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু কর্নারে দর্শনার্থীরা। ছবি: আব্দুস সালাম

অগ্রণী ব্যাংকে করা বঙ্গবন্ধু কর্নার দেশের দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু কর্নার। এর আগে আনসার-ভিডিপি ব্যাংকের এমডি থাকার সময় ২০১৬ সালে সেখানে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছিলেন মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম।

সম্প্রতি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এ কাজ শুরু হয়ে গেছে। গত ১৩ অক্টোবর রাজশাহীর ১ হাজার ৯৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার চালু হয়। ওই দিন নগরের হেলেনাবাদ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এস এম আবদুল কাদের জানান, ১ হাজার ৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৯২৫টি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় এ কর্নার করা হয়। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইনের তত্ত্বাবধানে সেখানকার ছয়টি উপজেলার ১ হাজার ১৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। অন্য জেলাগুলোতে এ উদ্যোগ নিয়ে কাজ চলছে।

জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডির বঙ্গবন্ধু কর্নারের ধারণাটি দুই বছর ধরে আলোচনায় রয়েছে। শামস্‌-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের ১২ জুন অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে চেক দিতে যাওয়ার সময় সাহস করে দুটি ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। চেক দেওয়ার পর দুরু দুরু বুকে প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, স্যার, আমি আমার অফিসে বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছি। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অনেক বই আছে। একটি ছবি দেখালাম। তিনি ছবি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তাঁর প্রশংসা পেয়ে আরেকটা ছবি বের করে বললাম, স্যার, আমি আনসার ভিডিপি ব্যাংকে থাকার সময় ওখানেও একটা এমন বঙ্গবন্ধু কর্নার করেছি। দুটো ছবিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাখলেন।’

শামস্‌-উল ইসলাম বললেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম যে বঙ্গবন্ধু কর্নার করা হচ্ছে সব স্কুলে। আমার খুব খুশি লেগেছে এতে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আদর্শ শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে জানতে পারবে। আমি এত দিন যে চিন্তাটা করেছি, যে ধারণাটি উপস্থাপন করেছি সেটার একটা স্বীকৃতি মিলল।’

প্রসঙ্গত, সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ আখতার জাহানও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আদর্শ শিক্ষার্থীদের জানাতে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের প্রস্তাব করেন।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

২০১৭ সালে এই প্রস্তাব আখতার জাহান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠান। তাঁর এই প্রস্তাবের পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে মতামত চায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে। গত বছরের ৮ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব সালমা জাহানের ওই চিঠির পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের বিষয়ে মত দেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পাঠানো প্রতিবেদনের পর সম্প্রতি দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শামস্‌-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকে এটা করেছি। যখন আমি অগ্রণী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম তখন (২০১০ সালে) সেখানে বঙ্গবন্ধু কর্নার করার উদ্যোগ নিই। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমার মতো ব্যক্তি এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। বড়জোর কোনো ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার হতে পারতাম। যার জন্য দেশটি স্বাধীন হলো, আমি জিএম হতে পারলাম, সেই বঙ্গবন্ধুর সম্মানে কিছু করার ইচ্ছে হলো। সিলেট অঞ্চলে অগ্রণী ব্যাংকের তিনটি জোনাল অফিসের মধ্যে মৌলভীবাজারের অফিসটি বেশ বড়সড়। তখন আমি কার্যালয়টির ফাঁকা জায়গায় বঙ্গবন্ধু কর্নার করার প্রস্তাব দিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি বুক শেলফ কিনে দিলাম এবং কর্মকর্তাদের বললাম, বঙ্গবন্ধুর ওপর যত বই লেখা হয়েছে, সবগুলো সংগ্রহ করে শেলফে জমা করতে। পরে নিজ উদ্যোগে বেশ কিছু বই কিনে শেলফ সাজিয়েছি। এভাবেই অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজার কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার গড়ে ওঠে। তবে তা সীমিত পরিসরে। পরে এমডি হয়ে যখন আনসার-ভিডিপি ব্যাংকে গেলাম, তখন মনে হলো ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় বিস্তৃত পরিসরে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করা সম্ভব। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপন করলাম।’

এই ব্যাংকার জানালেন, ইতিমধ্যে ন্যশনাল ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) কয়েকটি ব্যাংক এবং করপোরেট হাউস বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের যেসব শাখা নিজস্ব ভবনে আছে সেখানেও বঙ্গবন্ধু কর্নার করার পরিকল্পনার কথা জানালেন ব্যাংকটির এই প্রধান নির্বাহী। আর বর্তমান কর্নারটিকে আরও আধুনিক করার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরলেন তিনি।