ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী দল ও পরিবার

>
  • এবার জামায়াতের ২১ জন ধানের শীষ পেয়েছেন
  • বাকি ৪ জন স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিয়েছেন
  • স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে একজন বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন
  • সাজাপ্রাপ্ত আসামির স্বজনেরাও মনোনয়ন পেয়েছেন
  • ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার চালানোর ঘোষণা ঐক্যফ্রন্টের
  • ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে বিএনপি

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামী ও যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনে এসব প্রার্থী নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

তবে নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান রাখার ঘোষণা দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। আর ইশতেহারে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের ২৫ নেতা এবার প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২১ প্রার্থী সরাসরি বিএনপির হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। বাকি ৪ জন স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে একজন বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, ব্যাপক সমালোচনার মুখেও ভোটের অঙ্ক মাথায় রেখে জামায়াতের ২১ নেতার হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দিয়েছে বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপির অনেক নেতার মধ্যেও অস্বস্তি আছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আনফরচুনেট (দুর্ভাগ্যজনক)। বিএনপির এটা করা ঠিক হয়নি। জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল, তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবেই বা কেন?’

এ ছাড়া সন্ত্রাসী হামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের স্বজনদেরও বিএনপি প্রার্থী করেছে। এ নিয়েও সমালোচনা আছে। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান বিএনপির মনোনয়ন পান নেত্রকোনা-৪ আসনে। একই মামলার সাজাপ্রাপ্ত আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই সুলতান সালাহউদ্দিনকে টাঙ্গাইল-২ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত কেউ প্রার্থী না থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের দল এবং পরিবারের সদস্য হিসেবে সমালোচিত হচ্ছেন জামায়াতের প্রার্থীরা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় নিয়ে কারাগারে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম বিন সাঈদী পিরোজপুর-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন।

ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন জামায়াতের আব্দুল হাকিম। তিনি নাশকতার মামলায় বর্তমানে কারাগারে। সাতক্ষীরা-৪ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলামও নাশকতার মামলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১৫ আসনের ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হন জামায়াতের আ ন ম শামসুল ইসলাম। খুলনা-৫ আসনের প্রার্থী জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। খুলনা-৬ আসনের প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে খুলনা মহানগর জামায়াতের আমির। পাবনা-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইকবাল হোসাইন।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ কক্সবাজার-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তিনি বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন। তিনি কারাগারে আছেন। পাবনা-১ আসনে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাজিবুর রহমান মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এই আসনে ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাইয়িদ।

বগুড়ার আদমদীঘি এলাকার রাজাকার কমান্ডার ও বগুড়া-৩ আসনের সাবেক সাংসদ আবদুল মোমিন তালুকদার যুদ্ধাপরাধের মামলায় পলাতক। এবার বিএনপি প্রথমে মোমিন তালুকদারের স্ত্রী মাছুদা মোমিনকে মনোনয়ন দেয়। পরে তাঁর ভাই আবদুল মুহিত তালুকদারকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়। অবশ্য উচ্চ আদালতের রায়ে মুহিত তালুকদারের প্রার্থিতা অবৈধ হয়ে যায়। এরপর মাছুদা মোমিনকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দের আদেশ দেন হাইকোর্ট। তবে গতকাল পর্যন্ত তিনি ধানের শীষ প্রতীক পাননি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতকে ধানের শীষে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের দায় কাঁধে নিয়েছে।

এদিকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হয়েও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, এমন আটজনের একটি তালিকা সম্প্রতি সরকারসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে ছাড়া হয়েছে। যা হুবহু বিভিন্ন সংবাদপত্র ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোও ওই তালিকা পেয়েছে। তাঁরা হলেন আব্দুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও-২), গাজী নজরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা-৪), আ ন ম শামসুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৫), মিয়া গোলাম পরওয়ার (খুলনা-৫), শামীম বিন সাঈদী (পিরোজপুর-১), এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ (কক্সবাজার-২) ও ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান, মাছুদা মোমিন তালুকদার (বগুড়া-৩)। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জন জামায়াতের নেতা।

এই আটজনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তদন্ত সংস্থায়ও এঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

মাঠপর্যায়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, একাত্তরে এঁদের বয়স ১০-১২ বছরের মধ্যে ছিল। এঁদের চারজন-শামসুল ইসলাম, গাজী নজরুল ইসলাম, হামিদুর রহমান আজাদ ও আব্দুল হাকিম কারাগারে আছেন।

জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্যদের ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোকে বলেন, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী এক না। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত কেউ ঐক্যফ্রন্টের হয়ে এবার নির্বাচন করছেন না। স্বাধীনতাবিরোধী দলের কারও নির্বাচন করতে আইনগতভাবে কোনো সমস্যা নেই, তবে নৈতিকভাবে সমস্যা আছে। তিনি বলেন, শুধু ঐক্যফ্রন্ট নয়, পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এমন ব্যক্তি এবং স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী আরও কাউকে কাউকে ক্ষমতাসীন মহাজোট প্রার্থী করেছে বলে অভিযোগ আছে। স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সঙ্গে সরকারি দলের বড় বড় নেতার পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্কও রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-দুই দলই স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে কখনো কখনো কমবেশি রাজনীতি করেছে।