আ.লীগ-পুলিশের 'দাপটে' বিএনপি এলাকাছাড়া

নরসিংদীর সাহেপ্রতাপ মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিমে পলাশ উপজেলা, দূরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। এই পথ যেতে হয় আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথে। পথের দুই পাশের দৃশ্যও দৃষ্টিনন্দন। গ্রামীণ আবহ, সবুজের সমারোহে সবকিছুতেই শান্ত ভাব। কিন্তু এই পথ পেরিয়ে পলাশে পৌঁছাতেই কানে এল অশান্তির বার্তা। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ‘দাপটে’ এলাকাছাড়া বিএনপির নেতা–কর্মীরা। হামলা ও গ্রেপ্তার এখানে ‘নিয়মিত’ ঘটনা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে বিএনপির প্রার্থী থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।

পলাশ উপজেলা নরসিংদী-২ নির্বাচনী এলাকায়। উপজেলায় আছে চারটি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা। এর বাইরে নরসিংদী সদরের তিনটি ইউনিয়ন এই সংসদীয় এলাকায় পড়েছে। আসনটিতে এবার বিএনপির প্রার্থী আবদুল মঈন খান এবং আওয়ামী লীগের আনোয়ারুল আশরাফ খান।

গতকাল মঙ্গলবার এই নির্বাচনী এলাকার চরনগরদী, পারুলিয়া, পলাশ সদর, ঘোড়াশালসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও বিএনপির কোনো ধরনের প্রচারণা নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঝুলছে নৌকার পোস্টার, চলছে মাইকিং। দু-একটি জায়গায় আছে হাতপাখা প্রতীকের পোস্টার।

দুপুরে চরনগরদী বাজারে বিএনপির নির্বাচনী কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, লুঙ্গি পরা বয়স্ক এক ব্যক্তি পত্রিকা পড়ছেন। সেখানে আর কেউ নেই। জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি বিএনপির কেউ না, নেতা-কর্মী কে কখন আসবেন কিছু জানি না।’ শুধু এই কার্যালয় নয়, বিএনপি নেতাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে এমন সম্ভাব্য সব স্থানে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি। ফোনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললেও কেউ নাম প্রকাশ বা সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, আতঙ্কে আছেন তাঁরা। জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষ থেকে নির্বাচনী মাঠে না থাকতে হুমকি দেওয়া হয়েছে। হুমকি উপেক্ষা করে মাঠে নামায় হামলারও শিকার হতে হয়েছে।

জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গতকাল পর্যন্ত পাঁচ দিন গণসংযোগে নেমেছিলেন বিএনপির প্রার্থী মঈন খান। এর মধ্যে তিন দিনই তাঁর গণসংযোগে হামলা হয়েছে। সর্বশেষ হামলার ঘটনা ঘটে গত সোমবার। স্থানীয় বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সেনাবাহিনী নামায় মঈন খান আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে আর হামলার ঘটনা ঘটবে না। তাই কয়েক শ নেতা-কর্মী নিয়ে দুপুরে চরনগরদী থেকে মিছিল বের করেন। মিছিলটি তারগাঁও এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বাধায় মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়। এ বিষয়ে অভিযোগ দিতে মঈন খান উপজেলা পরিষদে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। এ সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে মঈন খানের ব্যক্তিগত সহকারী বাহাউদ্দীন ভূঁইয়া আহত হন। তিনি এখন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি, কাউকে আটকও করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি।

হামলা ছাড়াও বিএনপির কার্যালয় ও নেতাদের বাড়ি ভাঙচুর, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাসহ নানা অভিযোগ আছে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এর বাইরে পুলিশের বিরুদ্ধেও হয়রানি, গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন বিএনপির একাধিক নেতা। তাঁরা বলেন, তফসিল ঘোষণার পর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় অন্তত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যরা গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকাছাড়া।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মকবুল হোসেন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘সারা দেশের মতোই তাঁরা এখানেও মিথ্যা অভিযোগ করছেন। পুলিশ কোনো হয়রানি করছে না।’

সোমবারের ঘটনার পর থেকে ঢাকায় আছেন বিএনপির প্রার্থী মঈন খান। তাঁর বরাত দিয়ে স্থানীয় একজন নেতা বলেন, গত সোমবারের হামলার পর মঈন খান সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বলেছেন, ‘আমার ও আমার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা এলাকায় দাঁড়াতে পারছি না, প্রচারণা চালাতে পরছি না। আমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে।’

গণসংযোগ ও ভোটের মাঠে থাকবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এই নেতা বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। থাকলে বা পত্রিকায় আমার নাম প্রকাশ হলে আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে। আমার অপূরণীয় ক্ষতি করবে।’

নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বিএনপির এমন অভিযোগ থাকলেও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ভাস্কর দেবনাথ বলেন, ‘অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে পলাশের অবস্থা ভালো।’ সোমবারের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার কার্যালয়ের সামনে এমন ঘটনা ঘটায় আমি বিব্রত। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আর বাধা, হামলা, হুমকি নিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুল আশরাফ খান বলেন, ‘সারা দেশেই তাঁরা এমন অভিযোগ করছে। এটি নির্বাচনকে বিতর্কিত করার কৌশল। কাউকেই হুমকি বা বাধা দেওয়া হচ্ছে না।’ গত সোমবারের ঘটনার কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে তাদের ঝামেলা হয়েছে। নিজ দলের নেত-কর্মীদের হামলায় মিল্টন (বাহাউদ্দীন ভূঁইয়া) আহত হয়েছেন।’

এদিকে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি। একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললেও তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নির্বাচনকেন্দ্রিক উৎসবের আবহও নেই এ এলাকায়। তবে গতকাল বিকেলে পলাশ বাসস্ট্যান্ড থেকে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে বিশাল মোটর শোভাযাত্রা করেছে পলাশ মাইক্রো স্ট্যান্ড মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটি।

শোভাযাত্রাটি যাওয়ার সময় পাশ থেকে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা গেছে, ‘এলাকায় বিএনপির কেউ নাই, সবাই আওয়ামী লীগ।’