সৌহার্দ্যের পরিবেশে হঠাৎ উত্তাপ

>
আবদুল মান্নান ও আ স ম রব
আবদুল মান্নান ও আ স ম রব
* আ স ম রব এই আসন থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হন

* আবদুল মান্নান ২০০৮ সালে নির্বাচন করে বিএনপি প্রার্থীর কাছে হারেন
* রামগতি ও কমলনগরের নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ একেবারেই ভিন্ন
* কোথাও কোথাও দুই প্রার্থীর পোস্টার পাশাপাশিও দেখা গেল

লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরের নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ একেবারেই ভিন্ন। এই জেলার অন্যান্য আসনে যেখানে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ব্যানার–পোস্টারের দাপট, সেখানে এই আসনে এসে কিছুটা থমকে যেতে হয়। সংখ্যার দিক দিয়ে প্রধান দুই প্রার্থীর নৌকা ও ধানের শীষের পোস্টার প্রায় সমান সমান। কোথাও কোথাও দুই প্রার্থীর পোস্টার পাশাপাশিও দেখা গেল।

নির্বাচনী প্রচারণার এমন সৌহার্দ্যমূলক অবস্থান লক্ষ্মীপুর কেন, পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালীর কোথাও নেই। এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রচারণা শুরুর পর থেকে দুই পক্ষই প্রায় সমানভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে গত কয়েক দিন পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। নৌকার প্রার্থীর তিনটি কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ এনে ধানের শীষের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। আর এসব মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের নামে পুলিশ তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে। অন্যদিকে গত দুই দিনে ধানের শীষের প্রার্থীর ছয়টি নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হলেও পুলিশ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

রামগতি ও কমলনগর উপজেলা নিয়ে লক্ষ্মীপুর–৪ আসন। উপকূলীয় এই আসনটিতে এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। আর ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব। স্বাধীনতার পর আ স ম রব এই আসন থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হন। আর আবদুল মান্নান বিকল্পধারা থেকে এ আসনে ২০০৮ সালে নির্বাচন করে তখনকার বিএনপি প্রার্থীর কাছে হারেন। এই দুজন ছাড়াও এই আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আছেন।

নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে কথা হয় রামগতির বয়ারচর এলাকায়। তিনি তখন গণসংযোগ করছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কয়েক দিন ধরে গায়ে পড়ে ঝামেলা করছেন। তাঁরা নিজেরা নিজেদের কার্যালয় ভাঙচুর করে তাঁর নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছেন। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নেতা-কর্মীদের পেটানো হচ্ছে।

আ স ম রবের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট (সমন্বয়ক) আবদুল মোতালেব জানান, পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর থেকে। ওই দিন ও ২৩ ডিসেম্বর তাঁদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের দুটি অভিযোগ আনা হয়। এ দুই ঘটনায় কমলনগর ও রামগতি থানায় করা দুটি পৃথক মামলায় ২৩ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১৬০ জনকে আসামি করা হয়। গতকাল পর্যন্ত এই দুই মামলায় ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর ‘অজ্ঞাতনামাদের’ ধরতে প্রতিদিন নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছে পুলিশ।

তবে আ স ম রব বা তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্টের কেউই এসবের জন্য নৌকার প্রার্থী আবদুল মান্নানকে দায়ী করেননি। এর জন্য তাঁরা এই আসনের বর্তমান সাংসদ ও মান্নানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে দায়ী করেছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতা-কর্মীকে দিয়ে তিনি এসব করাচ্ছেন বলে তাঁদের অভিযোগ।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আ স ম রব তাঁদের মুরব্বি। তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য রয়েছে সত্য, তাই বলে তাঁর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মারধর বা তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করার মতো মানসিকতা তাঁরা পোষণ করেন না। উল্টো তিনি আ স ম রবের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ এনে বলেন, নিজেদের নেতা-কর্মীদের তাঁরা অনেক কষ্টে শান্ত রেখেছেন।

ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মী ও সাধারণ ভোটাররা পুলিশের হয়রানির বিষয়ে কমলনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেনকে দায়ী করছেন। তাঁদের অভিযোগ, এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গেও তাঁর সখ্য রয়েছে। ৮ ডিসেম্বর স্থানীয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা হলে পদপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এই ওসির বদলি চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছিলেন আ স ম রব। ১৭ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর দেওয়া ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কমলনগর থানার ওসির কর্মকাণ্ড, আচরণ, গতিবিধি নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টি করছে, যা আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। নির্বাচনের সময়ে তাঁর দায়িত্ব অব্যাহত থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনরোষ ও প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।’ তবে নির্বাচন কমিশন তাঁর এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ইকবাল হোসেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‌‌‌পুলিশের একার অভিযান পরিচালনার এখন কোনো সুযোগ নেই। এখন অভিযান পরিচালনা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনে নাশকতা করতে পারে, এমন ব্যক্তিদের তালিকা ‘ওপর থেকে’ তাঁদের দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকা ধরেই তাঁরা গ্রেপ্তার করছেন।