সামাজিক মাধ্যমে গণসংযোগ-তর্কাতর্কি

>
  • মাঠের বাইরে ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
  • গণসংযোগ ও তর্কাতর্কি করছেন কর্মী-সমর্থকেরা
  • ফেসবুক–অনলাইনে খবর–ভিডিও লিংক শেয়ার
  • বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো হয়েছে
  • দুই পক্ষ বোঝাতে চাইছে, কেন তাদের দল যোগ্যতর

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কষ্ট করে কন্যার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন বাবা। কেন এই কষ্ট? একটু খেয়াল করতেই দেখা গেল, বাবার হাতের আঙুলগুলো অকেজো, কুঁকড়ে গেছে। একটি চোখও অন্ধ। কী করে এমন, তার বর্ণনা ভিডিও ক্লিপে। তিনি আসলে গেল সংসদ নির্বাচনের সময় পেট্রলবোমায় আহত। এখন ভারী হয়ে যাওয়া জীবন কষ্টে বয়ে বেড়ান।

নৌকার পক্ষে যাঁরা ভোট চাইছেন তাঁদের প্রশ্ন, এরপরও কি বিএনপি-জামায়াতকে ধানের শীষে ভোট দেওয়া যায়? ভার্চ্যুয়াল জগতে পাল্টা জবাব দিয়েছেন ধানের শীষের সমর্থকেরা। তাঁদের প্রশ্ন, ‘নৌকা ভর্তি গুমের লাশ/ কোন সাহসে ভোট চাস?’ তারা গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনদের এনেছেন তাঁদের ভিডিওতে।

মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এভাবে মাঠের বাইরেও ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ফেসবুক ও অনলাইনে নিজেদের পেজে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবর ও ভিডিওর লিংক শেয়ার করছে তারা। পাশাপাশি পেশাদার বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের প্রচারে। দুই পক্ষই বোঝানোর চেষ্টা করছে, কেন তাদের দলটিই যোগ্যতর।

ফেসবুকে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল পেজ আওয়ামী লীগ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আছে বিরোধী জোটের পেজ। এর বাইরেও প্রার্থী সমর্থকদের নিজস্ব পেজ রয়েছে। সেখানেই চলছে গণসংযোগ ও বাগ্‌যুদ্ধ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগ পেজে শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় যা বলছেন তার ভিডিও ও বাণী, ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ নামে তরুণদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথনের ভিডিও জায়গা পেয়েছে এসব পেজে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্লোগান ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। তারা জানিয়েছে, বিসিএসে সর্বোচ্চ নিয়োগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি ২০০১-০৬ পর্যন্ত ১৬ হাজার ১৩৮ জন আর আওয়ামী লীগ ২০০৯-১৮ পর্যন্ত ৭২ হাজার ৪২৫ জনকে নিয়োগ দেয়। পদ্মা সেতু, বিদ্যুতায়ন, বিনা মূল্যে বই বিতরণ, সমুদ্রসীমা জয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তারা বলেছে, আবার সরকার গঠন করলে দুর্নীতি দমন করবে আওয়ামী লীগ। তারকাশিল্পীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কেন বাংলাদেশের পক্ষে, তা জানিয়েছেন।

শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী সমর্থকেরা ভার্চ্যুয়াল জগতে সবচেয়ে বেশি জায়গা দিয়েছে ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, বাগেরহাটের শেখ সারহান নাসের তন্ময় ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তৎপরতা তরুণদের লক্ষ্য করে। তারা ক্ষুদিরাম, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যে যে কারণে সমালোচিত, সে কারণগুলো কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে তাদের প্রচারে। ঐক্যফ্রন্ট মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে ভিডিও পোস্ট করেছে। পোস্টের বার্তা ছিল এমন, ‘ধর্ম যার যার, আমাদের এই দেশটা সবার। আসুন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে দেশটাকে গড়তে ৩০ তারিখ ধানের শীষে ভোট দিই।’

ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে আলোচিত বিভিন্ন সংবাদ যেমন স্বর্ণ বদলে গেল ব্যাংকের ভল্টে, সুনামগঞ্জ সেতুতে রডের বদলে বাঁশ, বুড়িমারী-মোংলায় কোটি কোটি টাকার ঘুষ, কয়লা গায়েব-ধামাচাপা দিতে তৎপর ছিল একটি চক্র, দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (টিআইবি)—এসব খবর প্রচার করছে। বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু, ছাত্রলীগের হাতুড়িপেটা থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল (পরে বহিষ্কৃত) খাদিজাকে কোপাচ্ছে—এমন খবর ও সম্পর্কিত ভিডিও প্রকাশ করে ঐক্যফ্রন্ট জানতে চেয়েছে, তরুণেরা আসলে কী চায়?

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আলোচনায় আসে চার তরুণের কণ্ঠে ‘ব্যাপার না অনেক হলো, ভোটে তোমার আওয়াজ তোলো’ নামের একটি কবিতার ভিডিও নিয়ে। এরপর আসে ড. কামাল হোসেনের ‘জেগে ওঠো বাঙালি, তোমার কান্ডারি প্রস্তুত’ শিরোনামে আরেকটি ভিডিও। তারপর তারা আপলোড করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভিডিওটি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভিডিওটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। তাঁর বাবার মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে ফেসবুক সরগরম হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ এ নিয়ে পাল্টা ভিডিও বার্তা প্রচার করা শুরু করে। এর জবাবে আবার বিএনপি-জামায়াতের নেতা–কর্মী–সমর্থকেরা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত ২২ যুদ্ধাপরাধীর তালিকা দিল—এই খবরটি শেয়ার করতে শুরু করেন। এই তালিকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের নাম আছে।

এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও পিরোজপুর-১ আসন থেকে ধানের শীষের প্রার্থী শামীম সাঈদীর ভিডিও বার্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শামীম যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে। তিনি বলছেন, ৩০ তারিখের একটি ভোট চারটি মুক্তি এনে দিতে পারে, খালেদা জিয়া, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, তারেক রহমান ও ‘আপনা’কে (যারা বা যাদের স্বজন কারাগারে আছেন)। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী–সমর্থকেরা ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘ধানের শীষে ভোট দিন/ রাজাকারের মুক্তি দিন।’

সব মিলিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে চলছে পাল্টাপাল্টি প্রচারণা। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সমানভাবে প্রচার-প্রচারণায় নামতে না পারলেও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে সমান সক্রিয়। আর এই আয়োজনই দিয়েছে এবারের নির্বাচনে ভিন্ন এক মাত্রা।