সাংসদ হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই ভাগ্য খুলেছে তাঁর

সাংসদ রেজাউল
সাংসদ রেজাউল

হলফনামায় বলেছেন, তাঁর বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। ভোটে দাঁড়ানোর আগে জমা টাকা ছিল ৩০ হাজার। চলাফেরা করতেন একটি পুরোনো মোটরসাইকেলে। তবে সংসদ সদস্য হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই ভাগ্য খুলেছে তাঁর। চড়ছেন ৩৪ লাখ টাকার গাড়িতে।

আলোচিত এই সাংসদ হলেন বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের রেজাউল করিম। তাঁর দাবি, গাড়ি কেনার টাকা ‘উপহার’ হিসেবে পেয়েছেন। তবে এলাকায় প্রচার আছে, শাজাহানপুর উপজেলার অবৈধ ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি এই গাড়ি কিনেছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর পেশা লেখা: ব্যবসা ও সাংবাদিকতা। তাঁর ও তাঁর ওপর নির্ভরশীল বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ সাংসদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর মাসিক আয় ছিল ৪১৭ টাকা।

হলফনামায় আয়ের উৎস বলা হয়েছে কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আসে ৩ হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে বছরে আয় ২ হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে তাঁর কাছে নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ৩০ হাজার টাকা। তাঁর মোটরসাইকেলের মূল্য ৫০ হাজার টাকা বলে উল্লেখ করেন।

তবে এলাকাবাসী জানান, রেজাউল করিমের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসাও নেই। বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা বুলেটিন-এর শাজাহানপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। বাংলা বুলেটিন-এর সম্পাদক তারেক হাসান শেখ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকার শুরু থেকে রেজাউল করিম উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর মাসিক কোনো বেতন ছিল না। কেবল মাসে ১ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেওয়া হতো। এখন আর সংবাদ পাঠান না, যোগাযোগও নেই। তাই সম্মানী ভাতাও দেওয়া হয় না।

তবে সাংসদ হওয়ার দুই মাসের মাথায় রেজাউল করিম টয়োটা কোম্পানির ‘নোয়াহ হাইব্রিড’ ২০১৫ সালের মডেলের একটি মাইক্রোবাস কিনেছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রমতে, চলতি বছরের ১২ মার্চ বিআরটিএ ঢাকার মিরপুর কার্যালয় থেকে মাইক্রোবাসটি নিবন্ধন করা হয় সাংসদ রেজাউল করিমের নামে। নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-১৯-৬৯০৯। ঠিকানা, সংসদ ভবন নম্বর ১, বাড়ি নম্বর ৫০৪, নাখালপাড়া, ঢাকা। রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেছেন, গাড়িটির দাম ৩৪ লাখ টাকা।

>

সাংসদ হওয়ার আগ পর্যন্ত রেজাউলের মাসিক আয় ছিল ৪১৭ টাকা
নির্বাচনের আগে রেজাউলের কাছে নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার
ব্যাংকে রেজাউলের জমার পরিমাণও ছিল ৩০ হাজার টাকা
সাংসদ হওয়ার দুই মাসের মাথায় রেজাউল মাইক্রোবাস কিনেছেন

এলাকায় প্রচার আছে, শাজাহানপুর এলাকার ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি কেনার টাকা নিয়েছেন। এই বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি স্থানীয় অবৈধ কিছু ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে তিনি (সাংসদ) টাকা নিয়েছেন। তবে এর সঙ্গে আমরা জড়িত নই।’

এই বিষয়ে সাংসদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ইটভাটার মালিক তো পাগল হয়ে যাননি যে আমাকে টাকা দিবে। এটা প্রপাগান্ডা।’ তিনি দাবি করেন, গাড়ি কেনার পুরো টাকা তাঁর এক বন্ধু উপহার হিসেবে দিয়েছেন।

হঠাৎ কেন এই ‘উপহার’ দিলেন—এই প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি সাংসদ হওয়ার পর খুশি হয়ে উপহার দিয়েছেন।’ তবে ওই বন্ধুর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেননি। বন্ধুর ফোন নম্বর চাইলে সেটাও দেননি। বললেন, ‘সবাই তো সবার সঙ্গে কথা বলবে না।’

ভাগ্যের ফেরে সাংসদ
রেজাউল করিম সাংসদও হয়েছেন ভাগ্যের ফেরে। বগুড়া-৭ আসনটি ‘জিয়া পরিবারের আসন’ হিসেবে পরিচিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলী ও পাশের উপজেলা শাজাহানপুর নিয়ে এ আসন গঠিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনেই এ আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি তিনি। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের গাবতলী উপজেলা শাখার মোরশেদ মিলটন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। আসনটি বিএনপিশূন্য হয়ে যায়। এখানে আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী ছিল না। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের পক্ষে। তিনি গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির আজম খানের স্ত্রী এবং শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খানের শাশুড়ি।

এই অবস্থায় ভোটের এক দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিমকে সমর্থন দেয় স্থানীয় বিএনপি। ট্রাক প্রতীক নিয়ে তিনি ১ লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর সাংসদ হওয়ার দুই মাসের মাথায় বদলে যায় আর্থিক অবস্থাও।

রেজাউল করিমের বাড়ি শাজাহানপুরের মাঝিড়া এলাকায়, বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক থেকে ১০০ মিটার পশ্চিম দিকে। সাংসদ হওয়ার পর বাড়ির সামনের সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, ‘এমপি রোড’।