বেলার প্রতিবেদন: পাথর কোয়ারিতে তিন বছরে ৭৬ শ্রমিকের মৃত্যু

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা। ফাইল ছবি
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা। ফাইল ছবি

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা বলতে শুধু নামটিই আছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে পুরোটাই এখন সমতল। টিলার ঢাল কাটা আর বিরাটাকার গর্ত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। স্তূপাকৃতির টিলার ধ্বংসাবশেষ থেকে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাথর তুলতে গিয়ে ঘটছে একের পর এক প্রাণহানি। শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি। টিলায় গর্ত খুঁড়ে পাথর তোলার সময় ধসে একসঙ্গে ছয় শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে ওই টিলা এলাকায় একের পর এক প্রাণহানি ঘটেছে। এ অবস্থা ঠেকাতে প্রশাসনের ধারাবাহিক অভিযানও চলছে। তবু পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না।

কাল বৃহস্পতিবার শাহ আরেফিন টিলায় একসঙ্গে ছয়জনের প্রাণহানির তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে। দিনটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আজ বুধবার একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বেলা জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি শাহ আরেফিন টিলায় একসঙ্গে ছয়জনের প্রাণহানি ঘটনার পর থেকে সিলেটের সব পাথর কোয়ারিতে শ্রমিক হতাহত হওয়ার ঘটনা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এতে এ বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সিলেটে যত্রতত্র পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে তিন বছরে ৭৬ জন পাথরশ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ জন।

বেলা জানায়, পাথরশ্রমিক পরিবার ও ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া তথ্যে তিন বছরে ৭৬ জনের প্রাণহানির তথ্য পাওয়া গেলেও সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৩৫। সর্বশেষ ১৫ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে ও শাহ আরেফিন টিলায় দুজনসহ সরকারি হিসাবে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭। এর মধ্যে এই বছরের শুরুতে কোম্পানীগঞ্জে দুজন ছাড়াও গত তিন বছরে সর্বাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে শুধু কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলায়। ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি, জৈন্তাপুরের শ্রীপুর, কানাইঘাটের লোভাছড়া ও বাংলাটিলা পাথর কোয়ারি এলাকায় ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৭৬ জন পাথরশ্রমিক।

গত মঙ্গলবার শাহ আরেফিন টিলায় সর্বশেষ টাস্কফোর্সের অভিযান পর্যবেক্ষণের পর বেলা আজ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, এভাবে চলতে থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে শুধু টিলার সর্বশেষ অস্তিত্বই বিলীন হবে না, এ ভূখণ্ডও হারিয়ে যাবে। সুতরাং পাথর উত্তোলনে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে শ্রমিক মৃত্যু থামানো যাবে না, রক্ষা করা যাবে না ভূখণ্ড। শ্রমিক মৃত্যু রোধে জরুরি ভিত্তিতে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রশাসনের উদ্যোগের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।

বেলার পর্যবেক্ষণ ও পাথর কোয়ারিতে একের পর এক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় জোরদার প্রশাসনিক তৎপরতায় একমত পোষণ করেছেন সিলেটের একাধিক বিশিষ্টজন। বেলার প্রতিবেদনে তাঁদের নামও উল্লেখ আছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে আছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ মাহমুদ চৌধুরী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম, সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি আজিজ আহমদ সেলিম, মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্ট সিলেটের সমন্বয়ক ইরফানুজ্জামান চৌধুরী, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সমন্বয়ক সৈয়দা শিরীন আক্তার, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী।

বেলা সিলেটের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে, সেখানে কোনো প্রাণহানি নেই। প্রশাসনকে আমরা এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখার আহ্বান জানাই। অন্যদিকে, যেখানে পাথর উত্তোলন হচ্ছে, সেখানে আরও নজরদারি প্রয়োজন। শাহ আরেফিন টিলায় প্রয়োজনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে। আমরা এ বিষয়টিও বিবেচনা করার আহ্বান জানাই।’

সরকারি খাস খতিয়ানের ১৩৭ দশমিক ৫০ একর জায়গায় শাহ আরেফিন টিলা। কথিত আছে, প্রায় ৭০০ বছর আগে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর অন্যতম সফরসঙ্গী হজরত শাহ আরেফিন (রহ.) খাসিয়া পাহাড় এলাকা পরিভ্রমণকালে পাহাড়-টিলার চূড়ায় বিশ্রাম নিতেন। শাহ আরেফিনের একটি ‘আসন’ (বিশ্রামের স্থান) হিসেবে পরিচিতি থেকে ওই টিলার নামকরণ হয়েছে শাহ আরেফিন টিলা। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এ টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথরখণ্ড। এসব পাথর উত্তোলন করতেই চলছে ধ্বংসযজ্ঞ।

ওই টিলার কিছু জমি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বন্দোবস্ত এনে প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ীদের একটি চক্র ২০০৯ সাল থেকে টিলা কেটে পাথর উত্তোলন করছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বেলা একটি কমিটির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণও করে। ৯৬ দশমিক ২৫ একর জায়গার ৭০ ভাগ টিলা কেটে ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ঘনফুট পাথর লুটপাটের তথ্য সংগ্রহ করে এ কমিটি।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শাহ আরেফিন টিলায় ১৩ জন। এ বছরের শুরুতে দুটো ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন শাহ অরেফিন টিলায়। ২০১৭ সাল থেকে শাহ আরেফিন টিলায় টাস্কফোর্সের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৯০টি টাস্কফোর্সের অভিযান হয়েছে। এতে ১ হাজার ৩৫৮টি নিষিদ্ধ বোমা মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে।

বেলার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন আচার্য প্রথম আলোকে বলেন, সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এখন মানুষ ও পরিবেশ নিয়ে। তাই বেলাসহ পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবাদীদের মতামত নিয়েই পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে শুধু একা প্রশাসনের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে না। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।