'রাস্তায় নামন ছাড়া উপায় আছিল না'

কাজ বন্ধ। কিন্তু ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। সাহায্যের আশায় তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। ছবি: প্রথম আলো
কাজ বন্ধ। কিন্তু ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। সাহায্যের আশায় তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। ছবি: প্রথম আলো

পান্থপথের মোড় থেকে একটু এগিয়ে ফয়জুন্নেসা বসে পানের সঙ্গে চুন মেশাচ্ছেন। কেউ ত্রাণ দেবে এখানে? প্রশ্ন শুনেই ফয়জুন্নেসা পান মুখে বললেন, ‘আইজ তিন দিন রাস্তায় নামছি। কিচ্ছু পাই নাই। সকালে একটা পানের আধাটা খাই, আর বাকিটা দুফরে। রাইতে পোলায় কিছু আনলে ৫ জনের সংসারে ভাগে এট্টু পেটে কিছু দেই।’

করোনাভাইরাসের কারণে সমাজের নিম্নবিত্তদের অনেকেই এখন কর্মহীন। সাহায্যের আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন তাঁরা।

ফয়জুন্নেসার সঙ্গে ছিলেন জুলেখা, রহিমন ও জাহাঙ্গীর আলম। কাঁঠাল বাগানের বাসিন্দা। অন্যের বাসায় গৃহকর্ম ও দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। কিন্তু এক ভাইরাস তাঁদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এলাকায় কেউ সাহায্য করেছে কিনা জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পাই নাই। যেরা দেয়া হেরা মুখ চিন্না দেয়।’

পান্থপথের বেশ কয়েকটি স্থানে ত্রাণের আসায় মানুষ সড়কের ধারে বসে আছে। গ্রিনরোডের কনসেপ্ট টাওয়ারের সামনে কয়েকজন বসে আছেন। গত কয়েক দিন ধরেই ত্রাণ পাবার আশায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে খেটে খাওয়া ও নিম্নবিত্ত মানুষ ঘুরছে।

ধানমন্ডির আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়কে ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষ। ছবি: প্রথম আলো
ধানমন্ডির আবাসিক এলাকার বিভিন্ন সড়কে ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষ। ছবি: প্রথম আলো

গত শুক্রবার দুপুরে ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ নম্বর সড়কে এ রকম সাহায্যের আশায় বসে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। সেদিন সড়কে কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি গেলেই তার পেছনে পেছনে ছুটেছে এই অসহায় মানুষেরা। কাকলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পরিবার নিয়ে বসে থাকা আবু হোসেন বলেন, ‘আইজ শুক্করবার, জুমার দিন। মানুষ যদি একটু বেশি সাহায্য দেয়। হেই আশায় বউ বাচ্চা নিয়া বইছি।’ পেশায় নির্মাণ শ্রমিক আবু জানান, যে এলাকায় কাজ করতেন সেখান থেকে গত ২৭ মার্চ তিন কেজি চাল, এক কেজি ডাল, আধা লিটার তেল ও দুই কেজি আলু পেয়েছিলেন।

কিন্তু চারজনের সংসারের জন্য তা অপ্রতুল। তাই সাত দিনের মাথায়ই তাঁকে রাস্তায় নামতে হয়েছে।

একই সড়কে কেয়ারি প্লাজার সামনে আজ বেশ কয়েকজন নারীকে বসে থাকতে দেখা যায়। এদের একজন আসমা বেগম জানেন সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাল বরাদ্দ দিয়েছে। তবে সেই চাল তাঁর কপালে জোটেনি। বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সরকার নাকি কত চাউল ছাড়ল, পাইল কারা?’ তাঁর কথার সঙ্গে আরও কয়েকজন গলা মেলালেন। তাঁদের অভিযোগ, যেসব জায়গায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে সেটা পরিচিতদের মধ্যেই দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা পাচ্ছেন না।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশা বেড়ে গিয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্দশা বেড়ে গিয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

সালেহা বেগমের স্বামী নেই। ঘরে দুই সন্তান। বড় ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাকে সঙ্গে নিয়েই বের হয়েছেন। সালেহা বলেন, ‘এক বাসায় কাম করতাম। গত মাসের ২০ তারিখেই না করে দিছে। বেতন দিছে। তয় ঘর ভাড়া দিয়া তো কিছু থাকে না। তাও এই কয়দিন চলছি। গত পরশু থেকে খাওন সব শেষ হইছে। রাস্তায় নামন ছাড়া আর উপায় আছিল না।’

ধানমন্ডির সড়কগুলোর আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন বাড়ির সামনে সাহায্য পাওয়ার আশায় মানুষ বসে থাকছে। কোনো কোনো বাড়ি থেকে হয়তো কেউ সাহায্য করছে। আবার কোনো কোনো জায়গা থেকে খালি হাতেই ফিরছেন তারা। ধানমন্ডির দুই নম্বর সড়কে দেখা যায় কয়েকজন বসে আছেন। মো. সিদ্দিকী দিনমজুরের কাজ করতেন। সাতজনের সংসার। স্ত্রীর কাজও বন্ধ। সিদ্দিকী বলেন, ‘কাজ বন্ধ হইলেও পেট তো বন্ধ করণ যায় না। সাতটা মানুষ এক বেলার মতো ঠিক কইরা খাইতে পারি।’