লঙ্ঘিতে হবে দুস্তর পারাবার

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ–বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

চাকরির কারণে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একা থাকি। বাড়ির কথা মনে হলেই রিমোট হাতে টেলিভিশনে সার্ফিং করি একটার পর একটা চ্যানেল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। অন্ধকারময় সময় আরও নিঃসঙ্গতা নিয়ে আসে। কফি হাতে জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা খুঁজি।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে বাজছে। নিষ্প্রাণ শহরের চেহারা যে এত নিষ্প্রভ হতে পারে, আগে কখনো বুঝিনি। কখনো বসে বসে চিন্তিত মনে একা একা পায়চারি করি। কখনো মোবাইল ফোন হাতে খবরের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করি। ছোটবেলা থেকেই পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। টেলিভিশন আমাকে তেমন টানে না। কিন্তু ইদানীং টেলিভিশনের খবরটা কিংবা মোবাইলের আপডেট তথ্যই বারবার দেখার তাগিদ অনুভব করছি। পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়তেও মনটা সায় দেয় না। কত প্রিয় খবর পত্রিকার পাতা ভরে থাকত আগে। এখন করোনায় সব বিবর্ণ।

রাত যত ঘনিয়ে আসছে, মনটা ততই কেমন যেন করছে। কাছের মানুষজনদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকি বলেই হয়তো স্থবিরতা আরও চেপে বসেছে। বয়স্ক মা-বাবাকে দূরে বাড়িতে রেখে এখানে অসহনীয় লাগছে। চাকরি সামলিয়ে চলতে গেলে অনেক কিছু গুটিয়ে আনতে হয়। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো রাত জেগে জেগে রবীন্দ্রসংগীত শুনেও মনের অস্থিরতা কাটে না।

একটি বাড়িতে চারতলার চারটা ঘরে আমরা চারজন থাকি। আমি ছাড়া বাকি সবাই একান্ত নিরাপত্তার জন্য আপনজনদের কাছে চলে গেছেন। এখন তো এই ঘরটাই আমার নিরাপদ আশ্রয়। দশ–পনেরো দিন হলো মেসের রাঁধুনি আসছে না। আগে দুবেলা রান্না হতো। খেয়েদেয়ে দিন চলে যেত। সহকর্মী উত্তমদা বলতেন, সুন্দর রান্নাও একটা আর্ট। এক বেলা খেয়ে দুবেলার কাজ চালিয়ে দেওয়ার জন্য আলুই মোক্ষম। তা ছাড়া রাঁধুনি না আসায় নিঃসঙ্গতা আরও এক ধাপ বেড়েছে বৈকি!

সকালে ব্যাংকে যাওয়ার পর কখনো কখনো মনে হয়, মানুষের কাছে টাকার গুরুত্ব এখনো কত বড়। নইলে এই সময়ে ডিপিএস জমা দেওয়ার জন্য এত ভিড় ঠেলে মানুষ আসে! অফিস শেষে বাসায় ফিরি। দেখি দরকারি জিনিসপত্র ফুরিয়ে এসেছে। মাস্ক পরে মুদির দোকানে গেলাম। চিংড়ি নিয়ে এলাম মাছের বাজার থেকে। ফিরে এসে নতুন অভ্যাসে সাবান দিয়ে হাত-পা পরিষ্কার করে কাপড়চোপড় ধুয়ে ফেললাম। রান্নার প্রস্তুতির সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এখন ফোন বাজলেই বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। ধরে দেখি আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল বন্ধু মহিম। কথা বলে রান্না করতে গিয়ে দেখি, একটুও লবণ নেই। উপায়ান্তর না দেখে আবার বাইরে বের হই। কিন্তু মুদিদোকান বন্ধ। খালি হাতে বাসায় ফিরলাম। খেতে হলো লবণ ছাড়া চিংড়ি আর লতি। কিন্তু লবণের ঘাটতি কি আর কিছু দিয়ে মেটে?

আবারও মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এবার মা। তাঁর কণ্ঠে চিরচেনা উদ্বেগ, ‘কখন ছুটি পাবি?’ বললাম, ‘চিন্তা কোরো না, চলে আসব কয়েক দিনের মধ্যে।’ ফোনটা রাখার পর নিঃসঙ্গতা আরও তীব্র হয়ে উঠল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছি, ব্যাংকারদের অনেকে নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক বন্ধ রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন। হয়তো ব্যাংক বন্ধ হবে। হয়তো তখন বাড়ি যাওয়া যাবে। আবার ভাবি, গণপরিবহন তো বন্ধ। যেতে পারব তো?

পৃথিবী তো আর এমন অচল থাকবে না। সব সচল আর স্বাভাবিক হয়ে আসবে। জানালার ওপাশে নারকেলগাছের পাতায় ঝিরিঝিরি বাতাস বইবে। কিন্তু এই সময়টাকেই মনে হচ্ছে দুস্তর পারাবার।