প্রকৃতির অট্টহাসি

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনায় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বাচাল পৃথিবীটাকে বড় অচেনা লাগছে। আজ স্বাধীন হয়েও আমরা পরাধীনতার এক অদৃশ্য কারাগারে বন্দী। প্রতি পদে পদে মৃত্যুভয় আমাদের ঘিরে ফেলছে। মনে হয়, এই বুঝি মৃত্যু এল।

সময়টা যদি অসময়ে থমকে না যেত, তাহলে আজ হয়তো হাজার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতাম। ভাগ্যের পরিহাসে আজ যেন পরিচয়–সংকটে পড়ে গেলাম। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল।

‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে।’
জগৎ দেখার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। তিনতলা ভবনের জানালা দিয়ে যত দূর চোখ যায়, ততটুকুই এখন আমার জগৎ। কখনো বা ছাদে গিয়ে পাশের বাড়ির শিশুগুলোর ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখি। একঘেয়ে লকডাউনে ঘরে বন্দী থাকলেও এটা বলা বাহুল্য যে এই সময়টাতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারছি। নিজেকে সময় দিতে পারছি। লকডাউনের দুই মাস পার হয়ে গেল। ইন্টারমিডিয়েটের দুই বছরে পড়ার চাপে তেমন কোনো বাইরের বই পড়া হয়নি। যাচাই করে নিলাম যে আগের মতো বইপোকা আছি নাকি। এ কদিনে ১৫টা উপন্যাস পড়েছি। এ ছাড়া কখনো বা হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধিয়ে, কখনো স্কেচ করে, কখনো বা গান রেকর্ড করে সময়টা কেটে গেছে। পাঁচটা গল্প আবার নিজে লিখেও ফেলেছি। এসব তো বর্তমানে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাগুলো ভুলে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।

জানি না এই মারণ ভাইরাসের মরণ কামড় থেকে কবে মুক্তি পাব আমরা। প্রতিদিন খবরের হেডলাইনে মৃতের সংখ্যা দেখে চোখ আটকে যায়। ভাবি, ঈশ্বরের সৃষ্ট দুনিয়ায় এত কষ্ট কেন? কেন এত যন্ত্রণা? মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ কি তাঁর কাছে পৌঁছায় না? জানি না কত স্বপ্ন নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবীর বুক থেকে। একেকটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

দেশের কথা চিন্তা করলে মনে হয় কত ভালো আছি। খেতে পারছি, থাকতে পারছি। কত কত মানুষ আছে যারা না খেয়ে থাকছে। না জানি কত মা তাঁর সন্তানের মুখে ভাত না তুলে দিতে পেরে নীরবে চোখের জল ফেলছেন। রাতের বেলা খেতে বসে ক্ষুধার্ত কুকুরের করুণ আর্তনাদ কানে এলে মনে হয় বিনা অধিকারে এই খাবার খাচ্ছি। এটি না দেখলে হয়তো বুঝতাম না ক্ষুধার জ্বালা ঠিক কতটুকু। মানুষ করোনাকে নয়, ক্ষুধাকে ভয় পায়।

এই ভয়ংকর দিনেও যে একদল মানুষ সবার মঙ্গল কামনার জন্য নিজেদের, এমনকি তাঁদের পরিবারের জীবন বাজি রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাঁদের শ্রদ্ধা আমরা বাঙালিরা কোনোদিনই জানাতে পারব না। আমরা শুধু তাঁদের ঘৃণাই করতে পারব। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবা করে যখন ডাক্তারটি বাসায় আসবেন, তখন বাড়িওয়ালা হিসেবে তাঁকে বাড়িতে না ঢোকার হুমকিই দিতে পারব। তাঁর পরিবারকে একঘরে করে দিতে পারব। করোনায় সেবারত নার্সকে দেখলে ইটপাথর ছুড়তে পারব। পুলিশ-সাংবাদিকদের বাসার উঠানে সব ময়লা–আবর্জনা ফেলতে পারব। আর যদি তাঁরা কোনোভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যান, তাহলে তো কোনো কথাই নেই! আর কিছু পারি বা না পারি, কেয়ামতের ভারটা সেদিন আমরা নিজের হাতেই তুলে নিতে পারব। কারণ, আমরা তো দায়িত্বশীল বাঙালি! আমরা বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না করার জন্য দিনে ১০ বার বাজারে যেতে পারব, পরিবারের টানে মাওয়া ঘাটে ঘিঞ্জি করে বাড়ি যেতে পারব। কিন্তু যেভাবেই হোক ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সাংবাদিকদের হাত থেকে পরিবারের মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে! হাজার হোক, আমরা বাঙালি তো! ভালোবাসার টানটা একটু বেশিই কাজ করে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আজকে এই করোনাকালে কেউ আপন নয়। নিজের স্ত্রী, সন্তান, স্বামী এমনকি মা–বাবাও নন। দেখবেন তো, ঘুষখোর পুলিশ, কসাই ডাক্তার, দুশ্চরিত্র নার্স আর মিথ্যাবাদী সাংবাদিক ছাড়া আপনার চিকিৎসা, সেবা কিংবা সৎকারের জন্য অন্য কেউ আসে না কি? আপনার সাড়ে তিন হাত জমির কবর খুঁড়তে কাউকে সেদিন পান নাকি? দেখবেন, সেদিন বাড়ির বড় ছেলেটা আসে নাকি আপনার মুখাগ্নি করতে।
আজও দোপাটি গাছটাতে লাল টুকটুকে দোপাটি ফুটছে; সাতরঙা প্রজাপতিটির রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে; সাগরের মধ্যে খেলছে ডলফিন; পাখিগুলো আকাশে মুক্ত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে; বন্দী শুধু আমরাই। প্রকৃতি যেন আমাদের নিয়ে খেলা করছে। আজ তার হাসি থামছে না। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে সে। হয়তো এ হাসি আমাদের কর্মফলের হাসি; এ হাসি তার অদৃশ্য প্রতিশোধের হাসি, যার অশ্রাব্য শব্দ মানুষকে তিলে তিলে তার কর্মফল ভোগ করার যন্ত্রণাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
* লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী, নরসিংদী সরকারি কলেজ, নরসিংদী। [email protected]