করোনাকালে বেহালে নারীর মাসিক স্বাস্থ্যবিধি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মহাখালীতে টুনির মায়ের ছোট একটা ব্যবসা ছিল। মেয়েদের অন্তর্বাস ও আনুষঙ্গিক উপকরণ বিক্রি করতেন তিনি। তাঁর স্বামী রিকশা চালাতেন। দুজনের আয়ে ভালোই চলছিল। প্রথম থেকেই কখনো প্যাড ছাড়া অন্য কিছু পরেননি। কিন্তু করোনা মহামারি সব ওলট–পালট করে দিল। নিজের আয় পুরোপুরি বন্ধ। আর স্বামীর রিকশা চালানো সীমিত হয়ে গেল এই অঘোষিত লকডাউনে। বাধ্য হয়ে পুরোনো কাপড় ব্যবহার শুরু করলেন। কোনোমতে ৬ বছরের টুনির খাবার জোগাড় করাই এখন কঠিন। মাঝে শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দিয়েছিল। প্রতি মাসের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন স্বামীকে বললেন প্যাড আনতে। বিনিময়ে চড়–থাপ্পড় আর গালিগালাজ।

করোনাকালে অবরুদ্ধ অবস্থায় টুনির মায়ের মতো নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীর স্বাস্থ্য পরিচর্যার হাল এমনই। কষ্ট করে জীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন এসব মানুষ। অপেক্ষাকৃত শোভন জীবনও যাপন করছিলেন। কিন্তু করোনা তা ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে এসব পরিবারের নারীদের ওপর; বিশেষ করে তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যায়।

নিম্ন বা স্বল্প আয়ের নারীরা কীভাবে তাঁদের মাসিককালীন ব্যবস্থাপনা করছেন, তা জানতে সম্প্রতি ওয়াটারএইড বাংলাদেশ একটি গুণগত গবেষণা করেছে। গবেষণায় ছয়টি ভিন্ন স্তরের মোট ৩০ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ছয় স্তরের মধ্যে আছেন নিম্ন আয়ের সম্প্রদায়, গার্মেন্টস কর্মী, শহরের মেয়ে শিক্ষার্থী, গ্রামের মেয়ে শিক্ষার্থী, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী। জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের বয়স ১৬ থেকে ৪৫ বছর। তাঁদের মধ্যে বিবাহিত, অবিবাহিত—দুই শ্রেণির নারীই আছেন। প্রতিবন্ধী নারীরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রতিটি সাক্ষাৎকারের গড় সময় ছিল ৯০ মিনিট। এ ছাড়া ১০টি ফার্মেসির দোকানিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

'নারীর মাসিককালীন ব্যবস্থাপনায় লকডাউনের প্রভাব' শীর্ষক এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন ওয়াটারএইডের হেড অব প্রোগ্রাম আফতাব ওপেল। তিনি বলেন, ‘চলতি মে মাসের প্রথম দিকে এ জরিপ চলে। নমুনা ছোট হতে পারে কিন্তু এর ব্যাপ্তি বড়। করোনার প্রভাব নানা খাতে পড়েছে। আমরা একটি দিক তুলে ধরেছি। কিন্তু এই সুনির্দিষ্ট বিষয় আমাদের জানান দিচ্ছে, নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব প্রকট।’

আফতাব ওপেল বলেন, করোনাকালে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার এই করুণ হালের কিন্তু এক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। কারণ, যেসব নারী এখন স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়ছেন, এর প্রভাব তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।

ওয়াটারএইডের গবেষণায় দেখা গেছে, কষ্ট করে হলেও অনেক নারী স্বাস্থ্য পরিচর্যা টিকিয়ে রেখেছেন। নিম্ন আয়ের এমন পরিবার দেখা গেছে, যেখানে নিজের মেয়েদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার খরচ মেটাতে মা প্যাড ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। এমন একজন সালেহা। তিন সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টের পরে যখন কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছিলেন, তার মধ্যেই এই মহামারির আবির্ভাব। মাস দুয়েক হলো তাঁর স্বামীর বেতন বন্ধ। বিপদের এই সময় খরচ কমাতে তাঁর স্বামী আর গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসেননি একবারও। এরই মধ্যে পিল বন্ধ করায় প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রতি মাসেই মাসিকের সময় অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে। লকডাউনের আগেই তাঁর স্বামী দোকান থেকে ওষুধ এনে দিলেও তাতে তেমন উপকার পাননি। সালেহার জন্য প্রতি মাসেই মাসিকের দিনগুলো অনেক কষ্টের। কিন্তু এই সময়ে আবার ডাক্তার দেখানো অনেকটা বিলাসিতাই সালেহার কাছে!

এত অভাবের মধ্যেও দুই মেয়েকে গত দুই মাসে মাসিকের সময় প্যাড কিনে দিয়েছেন সালেহা। পাঁচ মাস আগে অতিরিক্ত রক্তপাত শুরু হবার পর থেকে মেয়েদের কথা শুনেই সালেহাও প্যাড ব্যবহার শুরু করেছিলেন। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে খরচ কমাতে তিনি কাপড় ব্যবহার করছেন, যেন মেয়েদের প্রয়োজনমতো প্যাড নিশ্চিত করতে পারেন।

ইএসডিও এবং ওয়াটারএইডের একটি প্রকল্পে মাসিককালীন পরিচর্যা থেকে জেনে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার শুরু করেন গার্মেন্টস কর্মী বুলবুলি। তিনি থাকেন মিরপুরের এটি বস্তিতে। দুই বছর ধরে তিনি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে আসছেন। লকডাউনের সময় বেতন না পাওয়ায় তাঁর পক্ষে ন্যাপকিনের টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, কিন্তু তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ওই প্রকল্পের আওতায় কিছু ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা ছিলেন, যাঁরা অন্য কিছুর পাশাপাশি সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন, হারপিক ইত্যাদি বিক্রি করেন। ওই রকম একজন নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে তিনি বাকিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। এটা শুধু সম্ভব হয়েছে দুজন দুজনকে চেনেন, একই এলাকায় থাকেন, ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার কাছে পর্যাপ্ত মজুত থাকায় এবং সবশেষে গার্মেন্টস খুললে কর্মী বেতন পাবেন—এই আশায়।

স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রী কিনতে না পারায় অনেক নারীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ওয়াটারএইডের জরিপে অংশ নেওয়া এমন এক নারী কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারী শেফালি (৩৫)। সন্তান আর মানসিকভাবে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চলছিল তাঁর জীবন। তিনি এককভাবে পরিবারের ব্যয়ভার বহন করেন। প্রথম থেকেই স্যানিটারি প্যাডের পাশাপাশি অতিরিক্ত টিস্যু ব্যবহার করতেন, যাতে বারবার স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন না করে শুধু টিস্যুটি পরিবর্তন করতে হয়। তিনি খরচ কমানোর জন্য দিনে একবারই প্যাড পরিবর্তন করতেন। সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। কর্মরত অবস্থায় তিনি কখনো প্যাড পরিবর্তন করেননি। মহামারির এই দুঃসময়ে তাঁকে প্যাডের পরিবর্তে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে হচ্ছে। দোকান বন্ধ থাকার কারণে তিনি প্যাড কিনতে পারেননি। কাপড় দীর্ঘক্ষণ পরে থাকায় চুলকানি দেখা দিয়েছে।

স্কুলশিক্ষার্থীদের জীবনেও মহামারির জন্য আরোপিত লকডাউনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ করা গেছে। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের প্রায় সব উত্তরদাতাই বলেছেন, লকডাউনে মাসিকের দিনগুলোতে একধরনের বাড়তি মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। ঘরের মধ্যে পুরুষদের দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের কারণে অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে এসব নিয়ে তাঁরা পরিবারের কারও সঙ্গেই কোনো আলোচনা করেননি।

ওয়াটারএইডের জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শহরাঞ্চলের বস্তি বা নিম্ন আয়ের এলাকায় এসব পণ্যের ক্রেতা অনেক কমে গেছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত নারীরাও নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনছেন না বললেই চলে। তা ছাড়া এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ গ্রামে চলে যাওয়ার কারণেও বিক্রি কিছুটা কমেছে। অধিকাংশ এলাকায় লকডাউনের আগে হঠাৎ করেই স্যানিটারি প্যাড বিক্রি বেশি ছিল। গ্রামাঞ্চলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মাসিক ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত উপকরণের বিক্রি কমেছে, নারীরাও এসব পণ্য কিনতে দোকানে কম আসছেন।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনউইমেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বলেছেন, বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের কাছে এ সমস্যা প্রকট। 'কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: র‍্যাপিড জেন্ডার অ্যানালিসিস' শিরোনামে ওই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এ মাসেই। জেন্ডার ইন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের একটি জোটের উদ্যোগে ছিল এ গবেষণা। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪২ শতাংশ মানুষের করোনাকালে অপরিহার্য স্বাস্থ্য উপকরণ যেমন সাবান, স্যানিটাইজার ও মাস্ক ব্যবহারের সুযোগ নেই।

করোনার কারণে গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের নারীদের প্যাড ব্যবহারের হার কমে গেছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন সিমাভির অন্যতম কাজ নারীর স্বাস্থ্য পরিচর্যা। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের মাধ্যমে তারা স্বল্প খরচে প্যাড উৎপাদনে সহায়তা করে। সিমাভির বাংলাদেশি সমন্বয়ক (ওয়াশ প্রোগ্রাম) অলোক কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে তাঁদের সহযোগী তিনটি সংগঠন স্বল্প খরচে প্যাড উৎপাদন করে। কিন্তু করোনার কারণে এসব সংগঠনের প্যাড উৎপাদন কমে গেছে। এখন সংগঠনগুলো মাস্ক উৎপাদন করছে বেশি করে।

করোনাকালে মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতা স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা তৈরি করছে। আর এ জন্য করণীয় জানতে নারীরা আগ্রহীও হচ্ছেন। স্বাস্থ্য বাতায়ন সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের একটি সেবা। স্বাস্থ্য বাতায়নের হেল্পলাইন নম্বর ১৬২৬৩ তে ফোন করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে সরাসরি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন যে কেউ।

সিনেসিস আইটি লিমিটেড নামের একটি মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা দানকারী একটি প্রতিষ্ঠান এর ব্যবস্থাপনায় আছে। সিনেসিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রকোপ শুরুর পর স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিয়ে কলের সংখ্যা বেড়েছে। এ–সংক্রান্ত সমস্যায় নারীরা আগের চেয়ে এখন বেশি পড়ছেন, কলের ধরন দেখে তা বলা যায়।