সত্যটা জানা এখন পর্যাপ্ত নয়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন,

এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

করোনা–কালের এই ঘরবন্দী অবস্থায় যখন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার প্রথম চরণ দুটি পড়ছি, তখন ভেতরে একটি স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। বয়স এখন আঠারো দেখেই হয়তো স্বতঃস্ফূর্ততার প্রবলতাও অধিক।

দায়িত্ববোধের জুতসই প্রদর্শন এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং ঘরে বসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। তবে মন চাইছে আরও কিছু করতে কিন্তু এখনো সুযোগ পেলাম না।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমি এত দিনে জীবনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে দিতাম। আমি পাবলিক পরীক্ষাগুলোকে সব সময় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করেছি। কেননা, এখানে রণক্ষেত্রের মতো প্রতিযোগিতা নয় বরং নিজের সামর্থ্যকে সর্বশ্রেষ্ঠভাবে কাজে লাগানোর আনন্দ রয়েছে। তা ছাড়া পরীক্ষার সুবাদে প্রায় চার মাস পর কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো।

আমাদের কলেজে নভেম্বরের টেস্ট পরীক্ষার পরে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য কোনো কার্যক্রম থাকে না এবং এই সময়ে সবাই নিজের প্রস্তুতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এখন ঘরবন্দী অবস্থায় এই উৎসবের প্রসঙ্গ যে মস্তিষ্কের কোন কোণে পড়ে আছে বলা মুশকিল। এখন উৎসবের পরিবর্তে আমি বিশ্ববাসীর সঙ্গে এক অপ্রত্যাশিত রণক্ষেত্রে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে শত্রুর হিসাব-নিকাশ বদলে যাচ্ছে।

আমার ষাটোর্ধ্ব বাবা একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত রয়েছেন, যা জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত। তাই তাঁকে নিয়মিতই আফিসে যেতে হচ্ছে। আগে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকায় তিনি নিজ দায়িত্ব পালনে সদা প্রস্তুত অর্থাৎ নাছোড়বান্দা বলা চলে। তাঁর, পরিবার এবং প্রিয়জনদের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা পরীক্ষার সব দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরিবারের সবার স্বাস্থ্য রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবু সাবধানের মার নেই আর যেকালে ‘নিশ্চয়তা’ শব্দের ব্যবহার সামান্যই সেকালে দুশ্চিন্তা না করে উপায় কী।

এর মধ্যে আমি পত্রিকা এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়েছি। চেষ্টা করছি অলস সময়ে মুঠোফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার কমিয়ে দিতে। ফলে ক্ষতির চেয়ে বরং লাভ বেশি পাচ্ছি। প্রতিনিয়তই শিখছি: প্রধানত বাড়ির নানা কাজ, কখনো সহজ রান্নার উপায়, আবার কখনো নতুন দর্শন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।

গত বছর বইমেলায় কেনা আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসটা এত দিনে পড়ার সুযোগ পেলাম। ২৫ মার্চ রাতের নৃশংস গণহত্যার বর্ণনা যখন রক্ত গরম করে দিচ্ছিল, তখন বুঝতে পারলাম শহীদ আজাদ এবং তার সমবয়সীরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কেন এত উৎসাহী ছিল। আজ যখন সংবাদমাধ্যমে অমানবিক আচরণ, ত্রাণ চুরি এবং অন্যান্য হৃদয়ভঙ্গকর খবর বারবারই দেখি, তখন আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না। এই দুর্যোগকালীন সময়ে যে সত্য প্রকাশ্য তা প্রমাণ করে যে অসাধু লোকের অমানবিক এবং সাংঘাতিক ক্ষতিকর কাজকর্ম থেমে নেই। তবে নিশ্চয়ই শহীদ আজাদের মতো মানুষও আছেন অপ্রকাশ্যে, আড়ালে আশার বাণী হয়ে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সত্যটা জানা এখন আর পর্যাপ্ত নয়।

*এইচএসসি পরীক্ষার্থী, নটরডেম কলেজ। ক্যান্টনমেন্ট আ/এ, ঢাকা। [email protected]