লকডাউনে প্রবাসে আটকে ছেলে, মায়ের আকুতি

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনার বিপর্যয় ও লকডাউনের দুঃখের মুহূর্তগুলোতে আমাদের দুঃখগুলো এখন পৃথিবীব্যাপী। দুঃখগুলো সবার। প্রত্যেকটি মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সবার দুঃখ আমাদের দুঃখ। তারপরও প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত কিছু ছোট ছোট দুঃখ–কষ্ট, অপূর্ণতা আর অতৃপ্তি বোধ পোড়ায় মানুষকে। যদিও এত বড় ভয়াবহ মহামারির কাছে সেগুলো তেমন কিছু না। তবু ব্যক্তি মানুষেরা, আমাদের জীবন, মন, প্রিয় স্বজনের গুরুত্ব আমরা বেশিই দিয়ে থাকি জীবনে।

জীবনের সেই টুকরো টুকরো পাওয়া না–পাওয়াগুলোর অপূর্ণতা আমাদের তৃষ্ণার্ত করে। আমাদের কাঁদায়। আমাদের ভালো রাখে না একটুকুও। ঠিক তেমনই এক গল্প আমার। আমার সন্তানের। আজকের করোনার এই লকডাউনের এক ভয়ংকর উপাখ্যান আমার আর আমার সন্তানের জীবনে।

১৪ মে, আমার ছেলের জন্মদিন গেল। ১৯ পেরিয়ে ২০ বছরে পদার্পণ। পৃথিবীর সবটুকু সুখার্জিত ভালোবাসা আর দোয়া আমার সন্তানের জন্য সমর্পিত করার পরেও আমরা মা–ছেলে ভালো নেই। যদিও হাজারো উৎসব ভুলে আজ পুরো পৃথিবী মৃত্যুর মিছিলে শামিল। ভয়াবহ করোনা মহামারিতে পৃথিবী বিবর্ণ। বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে একে একে সব রকম আয়োজনের মানচিত্র। আজ আমাদের মন ভালো নেই। মন ভালো নেই পৃথিবীর সব মানুষের।

কতটা অসহায়ত্ব গ্রাস করেছে আমাদের প্রত্যেককে, তা আমরা জানি। সন্তান যেমন মাকে ছেড়ে ভালো নেই, পৃথিবীর কোনো মা-ও সন্তানকে ছেড়ে ভালো নেই।

আমার বাবাটা আজ লকডাউনে আটকে আছে। আমার শহর থেকে বহু দূর শহরের কোনো এক লকডাউন শহরে। একাকী বদ্ধ কোনো বাড়িতে। এমনিতেই একটু বেশি নিরিবিলি কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহর। যেখানে আমার বাবাই সোনা থাকে।

প্রতিদিনের চেয়ে এখন ওকে বেশিই মনে পড়ছে। আজ তার মায়ের কাছে থাকার কথা ছিল। এ বছর ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ওর সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ করে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী এয়ার টিকিট বুকিং করা ছিল। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা সব পাল্টে দিল। লকডাউনে আটকে গেলাম আমরা। ওর আর আসা হলো না মায়ের কাছে।

লকডাউনে আটকে পড়ার ঘোষণার প্রথম সেই দিনটায় আমার ছেলের সে কি কান্না।

কেন মা পৃথিবী সৃষ্টি হলো?
কেন পৃথিবীতে মানুষ এল?
কেন মানুষ এত অসহায় হলো?
কেন একটা ছোট্ট অণুজীবের শক্তি পৃথিবীর সব শক্তির চেয়ে বেশি বড় হলো মা?

ওকে সামলাতে না পেরে ফোনের এপাশ থেকে আমার কান্নার ধুম।
তার তখন হঠাৎ কেমন বড় হয়ে ওঠা।
মাকে কত কত সান্ত্বনা।
কত বোঝানো। কত কী!

সেদিনের পর প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেল। আর একদিনও ছেলে আমার কাঁদেনি। মাঝেমধ্যে শুধু ‘ভালো লাগে না মা’ আর ‘মা দেশে চলে আসব’, এই দুখানা কথা ছাড়া মন খারাপের আর কোনো বায়না নেই তার।

সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে পড়ল ওর পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে। দেশে ফিরতে না পারায় ইতিমধ্যে ওর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। ভিসার মেয়াদ শেষ। মানসিকভাবে আমরা আরও বিপর্যস্ত হলাম। লকডাউনের মধ্যেই কুরিয়ারে পাসপোর্ট রিনিউ করার জন্য অ্যাপ্লাই করলোদূতাবাসে। এখন ওর পাসপোর্ট–ভিসাছাড়া জীবন।

পৃথিবীতে আজ বেঁচে থাকাটাই যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে অনান্য চাওয়া গৌণ। তবুও জীবন আসলে অনেক কিছু চায়।

আমার ছেলের ওয়ার্ক পারমিট ছিল না। বয়স ও সব মিলিয়ে আবেদনও করতে পারেনি। আমার ছেলে কানাডা বা বাংলাদেশ কোথাও থেকে সরকারি কোনো আর্থিক সাহযোগিতা পায়নি, পাচ্ছে না। আমরা কারেন্সি পাঠাতে পারছিলাম না সব বন্ধ থাকায়। সে যে কী ভয়ংকর একটা বিপর্যয়। তা কেবল আমরা যারা ভুক্তভোগী, তারাই জানি।

আসলে মৃত্যুর মিছিল চোখে দেখা যায়। কিন্তু জীবনের এসব কান্না গোপনেই পোড়ায় মানুষকে। যেমন আমাদের মতো অনেককেই পোড়ায়।

পৃথিবীতে এভাবেই লকডাউনে আটকে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে আজ কত মা কত সন্তান। করোনা আমাদের খুব করে বুঝিয়ে দিল। অর্থ–বিত্ত–ক্ষমতা একটা ছোট্ট অণুজীবের কাছে কিছুই না।

প্রবাসে থাকা সন্তানের মায়েরা পৃথিবীর কোথাও ভালো নেই। তাদের সন্তানদের দূর প্রবাসে সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্নপূরণের আসায় পাঠিয়ে। কোনো মায়েরই ঠিকমতো ঘুম হয় না। লুকিয়ে লুকিয়ে সব মা–ই কাঁদে।

আর কী দেখতে পাবে সন্তানের মুখ?
নিজেই কী বাঁচবে। নাকি প্রিয় সন্তানকেই হারাবে?

সব থাকতেও আজ আমার সন্তান যখন এভাবে কষ্ট পায়। মা তখন সন্তানকে বুঝতে না দিয়ে, খুব সাহসী মা হয়ে তার সঙ্গে রোজ কথা বলি। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি। আর একবার কাছে এলে কখনোই আর ওকে দূরে যেতে দেব না।

আমরা কম খাব, কম পরব, কম জানবে, কম শিখব, কম শিক্ষিত হব—তবু কাছাকাছি থাকব।

যদিও এর মধ্যেও একটা ভালো খবর হলো, বাবাইয়ের পরবর্তী সেমিস্টার ফি অগ্রিম দেওয়া ছিল বলে ওকে ভিসার জন্য আটকায়নি। ভর্তি হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, এই তো কিছুদিনের মধ্যে ইনশাআল্লাহ ওর অনলাইনেই পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে।

জানি না আর কত মাস, বছর আমরা এভাবে করোনা বিধৃত আমাদের অনিশ্চিত জীবন কাটাব!
আমরা প্রিয় দূরত্বে থাকব। আমরা মৃত্যুর শহরে ঘুমাব!

স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, পৃথিবীর সব মা সন্তানকে বুকে ফিরে পাক। সব সন্তান মাকে, তার পরিবারকে নিজের কাছে ফিরে পাক। পৃথিবী আবার নিরাপদ হোক। সবাই সুস্থতায়, সৌহার্দ্য আর প্রিয় সান্নিধ্যে বাঁচুক।

আমার বাবাই এর জন্য সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায় বলব,

‘জীবিতের জন্মদিন বন্ধুদের কাছে। আর মৃতের জন্মদিন যদি কিছু সু-কীর্তি থাকে।’

বাবাই, পৃথিবীতে যত দিন বাঁচো, সু-কর্মে বাঁচো। মৃত্যু যেন তোমার জীবনে শুধু মুছে যাওয়া সমাধি না হয়। জীবন অথবা মৃত্যু তোমাকে যেন এই পৃথিবীর বুকে সু–কর্মে ও সু-চিন্তায় বাঁচিয়ে রাখে সহস্র সহস্র বছর।

তুমি বাঙালি।
আমরা সাহসী জাতি, সংগ্রামী জাতি, বীরের জাতি।
এটাই আমাদের পরিচয় হোক পৃথিবীর মানচিত্রে।

*মতিঝিল, ঢাকা। [email protected]