করোনার থাবা মেট্রোরেলের কর্মীদের ওপর

ফাইল ছবি: আশরাফুল আলম
ফাইল ছবি: আশরাফুল আলম

করোনা থাবা বসিয়েছে ঢাকার বহুলপ্রতীক্ষিত মেট্রোরেল প্রকল্পেও। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত ৯০ জন কর্মী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন। প্রত্যেক কর্মীকে করোনা পরীক্ষা করে কাজে যোগ দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। তাই সামনের দিনগুলোয় আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। এ জন্য দুটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মেট্রোরেলের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের কাজের ঠিকাদার আলাদা। তাঁদের কাজের তদারকি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।


ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, ঠিকাদার ও পরামর্শকদের বেশির ভাগই জাপানের নাগরিক। প্রকল্পের অর্থায়নকারীও জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। করোনা পরিস্থিতির কারণে জাপানের সব নাগরিকই দেশে চলে গেছেন। তাই মার্চের শেষে লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

জুনের শুরুতে লকডাউন উঠে গেলেও জাপানিসহ অনেক বিদেশি ফেরেননি। আর যেসব বিদেশি ও দেশি কর্মী আছেন, তাঁদেরও প্রত্যেককে করোনা পরীক্ষা করে কাজ যোগ দেওয়ার শর্ত দেয় জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি আক্রান্ত হলে দেশি-বিদেশিদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল নির্দিষ্ট করার তাগিদ দেয়।
প্রকল্প সূত্র বলছে, প্রথমে করোনা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েও সাড়া মেলেনি। এরপর প্রকল্প কর্তৃপক্ষ রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে। ৩ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৫০ জনের মতো পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৯০ জনের করোনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে ফার্মগেটে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডের একটি কার্যালয়ে ২৫ জনের করোনা পজিটিভ হওয়ার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।


লকডাউনের আগে মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার লোক কাজ করছিলেন। তাঁদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে পরামর্শক, ঠিকাদার, ঠিকাদারের সহযোগী (সাবকন্ট্রাক্টর)। এর মধ্যে পরামর্শকদের প্রায় সবাই বিদেশি। অল্প কিছু দেশীয় পরামর্শক আছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ও দেশি সব মানুষই আছে। আর ঠিকাদারি সহযোগীদের প্রায় সবাই দেশি।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, পরামর্শক, ঠিকাদার ও ঠিকাদারের সহযোগী—একটি অপরটির পরিপূরক। একটার ঘাটতি হলে অন্যটির কাজ চালানো যায় না। চীন ও থাইল্যান্ডের পরামর্শক ও ঠিকাদার এবং তাদের অধীন দেশীয় কর্মীদের অনেকে কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা উত্তরার ডিপো এলাকা এবং উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে কাজ করছেন।


তবে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের মূল ঠিকাদার জাপানি। তাঁরা কবে কাজে যোগ দেবেন, এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এই অংশের কাজও পিছিয়ে আছে।

প্রকল্প সূত্র বলছে, ৩০ জুনের পর ফিরে আসার বিষয়ে জাপানিরা পুনর্মূল্যায়ন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত তাঁরা কিছু জানাননি। জাপানিরা আগেই বলেছেন, সংক্রমণ কমতির দিকে না গেলে তাঁরা ফিরে আসবেন না। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ আছে। এ কারণে খুব শিগগির জাপানিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।

জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, যে পরিমাণ করোনার পরীক্ষা করা হয়েছে, সে তুলনায় আক্রান্তের হার খুব বেশি নয়। তবে তাঁরা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। পুরোদমে কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, জাপানের সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ স্থাপিত হলে শতভাগ কাজ শুরু করা যাবে। এখন বেশি কাজ হচ্ছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে। তিনি জানান, মেট্রোরেলের ইঞ্জিন-বগি তৈরির কাজ জাপানে পুরোদমে চলছে। জুনে এক সেট ট্রেন বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারেনি। তবে ওই সেটের কাজ শেষে করে আরও ট্রেন নির্মাণের কাজ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

দুটি ফিল্ড হাসপাতাল

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসা পাচ্ছে না—পত্রপত্রিকায় এমন খবর দেখে জাপানের পরামর্শকেরা নিজেরা আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। এমনকি দেশি-বিদেশি যাঁরা এখন বাংলাদেশে আছেন, তাঁদেরও কাজে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে করোনার পরীক্ষা ও হাসপাতাল ঠিক করার শর্তে জুড়ে দেন পরামর্শকেরা।


এই শর্ত পেয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ করোনার পরীক্ষার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে। আর চিকিৎসা সেবার জন্য ইমপালস হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে। পাশাপাশি গাবতলী ও উত্তরায় দুটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো তত্ত্বাবধান করবে ইমপালস হাসপাতাল।

মেট্রোরেল প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফিল্ড হাসপাতাল দুটিতে সাধারণ চিকিৎসা এবং অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকবে। তবে কোনো আইসিইউ শয্যা থাকছে না। কারও আইসিইউ দরকার হলে ইমপালস হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।


মেট্রোরেলের আটটি প্যাকেজের ঠিকাদার আলাদা আলাদা। এ জন্য ফিল্ড হাসপাতালগুলোয় প্রতিটি প্যাকেজের জন্যে ৫ থেকে ১০টি শয্যা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ফিল্ড হাসপাতাল চালু করা যাবে বলে জানিয়েছেন ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন সিদ্দিক।

প্রকল্পের কর্মীদের এখন শুরুতেই ১১টি প্রশ্নের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। এরপর করোনা পরীক্ষা এবং আইসোলেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উত্তরায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আইসোলেশন সেন্টার আছে। সেখানে দুই শতাধিক কর্মীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।


বেসরকারিভাবে করোনার পরীক্ষা, আইসোলেশন সেন্টার ও হাসপাতাল স্থাপনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, বিদেশিদের সার্বক্ষণিক রাখতে হলে আরও কিছু নামীদামি হাসপাতালের শয্যা সার্বক্ষণিক বরাদ্দ করতে হবে। এর ফলে কাজের ধীরগতির পাশাপাশি বাড়তি খরচের ধাক্কাও সামলাতে হবে।

এসব বিষয়ে মেট্রোরেলের এমডি এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত তাঁদের কেউ গুরুতর অসুস্থ হননি। এরপরও পরামর্শক, ঠিকাদার ও কর্মী—সবার মধ্যে আস্থা ফেরাতে সব রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাড়তি খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খরচ বাড়বে। তবে অন্য খাতে খরচ কমে যাবে। তাই সব মিলিয়ে খরচ বাড়বে না।

সরকার আগামী বছর ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মেট্রোরেল চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা অনেকটাই দুরূহ।
মে পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৪৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজের অগ্রগতি ৭২ দশমিক ১২ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজ এগিয়েছে ৩৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।


মেট্রোরেল হচ্ছে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। পুরো পথের দূরত্ব ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। মিরপুর পল্লবী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, সংসদ ভবন, ফার্মগেট, শাহবাগ, দোয়েল চত্বর ও প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল যাবে। পথে হবে ১৬টি স্টেশন।