চার পরিবারকে একঘরে, কথা বললেই জরিমানা

চার পরিবারের এই সদস্যদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। বুড়িকদমা গ্রাম, সিংড়া, নাটোর, ৬ জুলাই। ছবি: মুক্তার হোসেন
চার পরিবারের এই সদস্যদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। বুড়িকদমা গ্রাম, সিংড়া, নাটোর, ৬ জুলাই। ছবি: মুক্তার হোসেন

নাটোরের সিংড়া উপজেলার ইটালি ইউনিয়নের বুড়িকদমা গ্রামের চারটি পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বললেই গুনতে হবে ৫০০ টাকা জরিমানা। গ্রামের একটি প্রভাবশালী মহল তাদের একঘরে করে রেখেছে।

সোমবার সিংড়া থানা–পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মান্নান তাঁর ভাই গোলাম মোস্তফা, মোতালেব হোসেন ও মহব্বত আলী দীর্ঘদিন থেকে বুড়িকদমা গ্রামে বসবাস করে আসছেন। তাঁরা গ্রামের একটি পীরের মালিকানাধীন জমিতে মাদ্রাসা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু গ্রামের কিছু মাতবরকে হাত করে জিল্লুর রহমান নামের এক ব্যক্তি প্রায় আট মাস আগে ওই জমিতে বাড়ি নির্মাণ করেন। শুধু তা–ই নয়, গ্রামে ঈদগাহ থাকা সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহল আব্দুল মান্নানদের বসতবাড়ি সংলগ্ন ২০ শতক জমিতে ঈদগাহ মাঠ বানানোর প্রস্তাব দেন। তাঁরা এতে সম্মত না হলে আব্দুল মান্নানসহ ওই চার পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেন। মাতবরদের দেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে তাঁদের সঙ্গে গ্রামের অন্যদের কথাবার্তা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ছেলেমেয়েরা প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশা করতে পারবে না। তাঁদের বাড়িতে কেউ কাজে যেতে পারবে না, তাঁরাও অন্যদের বাড়িতে কাজে যেতে পারবেন না। গ্রামের মসজিদে ও ঈদগাহে ঢুকতে পারবেন না বলেও নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়। এক মাস ধরে ওই চারটি পরিবার নিষেধাজ্ঞার আওতায় একঘরে জীবন যাপন করছে। তবে নিষেধাজ্ঞার চাপ সইতে না পেরে প্রতিবেশী ফটিক হোসেন নামের এক ব্যক্তি বাড়িঘর ছেড়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের গ্রামে পালিয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে ফটিক হোসেন বলেন, তাঁর অপরাধ, তিনি আব্দুল মান্নানদের সমর্থন করেন এবং মাতবরদের অন্যায় মেনে নেননি। তাই তাঁকে গ্রামছাড়া ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এক মেয়ে স্নাতকে পড়ালেখা করে। মাতবরদের বিধিনিষেধের চাপে আমার মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছি।’

আব্দুল মান্নানের অভিযোগ, তাঁরা চার ভাই গ্রামের আদি বাসিন্দা। গ্রামে একজন পীরের নামে বেশ কিছু জমি আছে। এসব জমি এলাকার মাতবর রেজাউল করিম, আব্দুর রশিদ, আনিসুর রহমান ও তাঁদের সমর্থকেরা ইচ্ছেমতো ভোগদখল করতে চান। তাঁরা চার ভাই তাতে বাদ সাধলে মাতবরেরা জোট বেঁধে তাঁদের ওপর অন্যায় অত্যাচার চালান। একঘরে করে তাঁদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। যেন তাঁরা গ্রাম ছেলে অন্য কোথাও চলে যান।

অভিযোগ অস্বীকার করে রেজাউল করিম ও আব্দুর রশিদ বলেন, আব্দুল মান্নানেরাই ভূমিদস্যু। তাঁরাই পীরের জমি ভোগ করছেন। তাঁদের একঘরে করা হয়নি। তবে প্রয়োজন না থাকায় তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা হয় না।

আজ সোমবার দুপুরে বুড়িকদমা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটিতে ঈদগাহ, কবরস্থান ও একটি মসজিদ রয়েছে। কবরস্থানের পাশেই রয়েছে ঈদগাহ। সামাজিক এসব প্রতিষ্ঠানে আব্দুল মান্নানদের পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আব্দুল মান্নান ও তাঁর ভাইয়েরা খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের প্রতি জুলুম করা হচ্ছে। আমি সত্য কথা বলায় আমার বাড়ির সামনে মাতবরদের চামচারা বেড়া দিয়েছে। আমার চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।’

ইটালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম বলেন, আব্দুল মান্নানদের একঘরে করে রাখার বিষয়টি তিনি জানেন না। কেউ তাঁর কাছে অভিযোগও দেননি। অভিযোগ পেলে সমাধানের চেষ্টা করবেন।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর-এ-আলম সিদ্দিকী বলেন, একঘরে করার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। এর আগে আব্দুল মান্নানদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মারপিট ও গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ করা হয়েছিল। সেটি মামলা নিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে একঘরে রাখার বিষয়টি প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।