ফরিদপুরের নুরুলের মতো ভালো কাজ করুন আপনিও

সড়ক বিভাজকে খেজুরের বীজ লাগাচ্ছেন নুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
সড়ক বিভাজকে খেজুরের বীজ লাগাচ্ছেন নুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

ফরিদপুরের মুজিব সড়কে সেই আগের ব্যস্ততা নেই। স্বাভাবিকভাবে স্কুল–কলেজের গেটে তালা। কোর্টপাড়ে দেখা গেল না কেতাদুরস্ত পোশাকের মানুষের কর্মচঞ্চলতা। টেপাখোলার পড়াশোনা করা তরুণদের প্রিয় ‘ইউসুফ ভাই’–এর চায়ের দোকানের ক্যারম বোর্ডের স্ট্রাইক–গুটিরও নেই টুকটাক শব্দ। দৈনন্দিন জীবনের সব ব্যস্ততা ও ছোট উচ্ছ্বাসগুলোকে ছুটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে অদৃশ্য শক্তিশালী করোনাভাইরাস।

কিন্তু করোনাকালীন এই সংকটের মধ্যেও নিজের সমাজসেবামূলক কাজ থামাননি নুরুল ইসলাম। প্রতি মাসে যে একটি ভালো কাজের লক্ষ্য স্থির করেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা এই করোনার মধ্যেও পালন করে যাচ্ছেন ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী এই শিক্ষক (রসায়ন)। জুন মাসের ভালো কাজ হিসেবে জেলা শহরের রাস্তায় রোপণ করেছেন দুই হাজার খেজুরবীজ।

ছাত্র অবস্থা থেকেই সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের খ্যাতি আছের নুরুলের। পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার পর আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ায় কর্মকাণ্ডের গতি যায় বেড়ে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে লক্ষ্য স্থির করেন, প্রতি মাসে নিজ অর্থায়নে সমাজের জন্য একটি করে ভালো কাজ করবেন। শুরুটা করেছিলেন ২০০ রিকশাচালকের মধ্যে সকালের নাশতা বিতরণ করেন।

করোনার সময়ে এসে প্রায় সবকিছুর মতো থেমে যেতে পারত তাঁর কাজও। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কাছে হার না মেনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালিয়ে নিয়েছেন সমাজসেবা। এরই অংশ হিসেবে গত জুন মাসে রোপণ করেছেন খেজুরের বীজ। ২৭ ও ২৮ জুন দুই দিন সময় নিয়ে ফরিদপুর শহরের রোড ডিভাইডারে দেশি খেজুরবীজ রোপণ করেছেন ৪১ বছর বয়সী এই শিক্ষক। জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন টেপাখোলা রেলক্রসিং থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পৌরসভা ভবন, জনতা ব্যাংকের মোড়, আলীপুর, পুরোনো বাসস্ট্যান্ড হয়ে পশ্চিম খাবাসপুরের প্রধান সড়কের রোড ডিভাইডারগুলো।

ভালো কাজের অংশ হিসেবে কেন খেজুরগাছ বেছে নেওয়া? নিজ জেলার ঐতিহ্যের দিকেই চোখ নুরুলের, ‘দেশি খেজুরগাছ ও খেজুরের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল ফরিদপুর। কিন্তু এখন খেজুরগাছও নেই , গুড়ও নেই। হারিয়ে গিয়েছে আমাদের ঐতিহ্যও। তাই খেজুরগাছ লাগানো। মানুষ যেন ফরিদপুরে এলে জানতে পারে ফরিদপুরের ঐতিহ্য সম্পর্কে। এ ছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনও তো হলো। তাই জুন মাসের ভালো কাজ হিসেবে খেজুরগাছকেই বেছে নিয়েছি। এই যুগে এসে খেজুরের বীজ পাওয়া অনেক কঠিন। খুব কষ্ট করেই বীজগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে।’

খেজুরের বীজ লাগানো ছাড়া করোনাকালে তাঁর ভালো কাজগুলো হলো মার্চ মাসে নদীদূষণ রোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পদ্মা নদীর পাড়ে ধলার মোড়ে ও ভাজনডাঙ্গা ভুঁইয়া বাড়ির ঘাটে একটি করে বিলবোর্ড স্থাপন করা। এপ্রিলে নিজ এলাকার দুস্থ ও দরিদ্র প্রতিবেশী ২৫টি পরিবারের মধ্যে পাঁচ কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, আধা কেজি লবণ ও একটি সাবান বিতরণ করেন। মে মাসে ঘটে একটি বিপত্তি। নদীদূষণ রোধে যে বিলবোর্ড স্থাপন করেছিলেন, ঝড়ে তা ভেঙে পড়ে। পরবর্তী সময়ে মে মাসের ভালো কাজ হিসেবে সেই বড় বিলবোর্ড দুটি মেরামত করান।

ভালো কাজের অংশ হিসেবে বর্ষার এই মৌসুমে গাছেরই লাগানোর দিকেই নজর তাঁর। পরবর্তী তিন মাসের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন মানুষ গড়ার এই স্কুলশিক্ষক, ‘জুলাই মাসে কৃষ্ণচূড়াগাছ লাগাব। এর পরের দুই মাসেও গাছ লাগানোরই ইচ্ছে।’

একটি প্রশ্ন এসেই যায়, সরকারি জমিতে গাছ লাগাতে গিয়ে প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয় কি না? তাঁর সহজ জবাব, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই গাছ ভালোবাসি। যেখানেই সরকারি ফাঁকা জমি পাব, সেখানই গাছ লাগাব। যদিও প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয় না। আমি মনে করি, ভালো কাজ কাউকে জানিয়ে করার প্রয়োজন নেই। প্রশাসন যদি মনে করে গাছের প্রয়োজন নেই, তাহলে কেটে ফেলবে। এতে আমার দুঃখ নেই।’

নদীদূষণ রক্ষার্থে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিলবোর্ড স্থাপন করছেন নুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
নদীদূষণ রক্ষার্থে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিলবোর্ড স্থাপন করছেন নুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

ফরিদপুর শহরের কমলাপুরের লালের মোড়ে বসবাস করেন নুরুল। তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ফকির আবদুর রহমান। ব্যক্তিজীবনে নুরুল এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। মুক্তিযোদ্ধা বাবার কাছে থেকেই সমাজের জন্য ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ও মা ছোটবেলা থেকেই আমাদের ভালো কাজে উৎসাহ দিতেন। সমাজের কথা বলতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই এই অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে।’

নুরুলকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আফরোজা খানম,। তিনি বলেন, ‘নুরুল শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো। ছাত্রীরা শিক্ষক হিসেবে তাঁকে খুব পছন্দ করে। আর তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের কথা তো আমরা সবাই জানি।’

শিক্ষক মানেই মানুষ গড়ার কারিগর। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, কাজটি তিনি ভালোই করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তিনি যেসব ভালোর মধ্যে দিয়ে আলোর মশাল জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছেন, তাতে তো পথ দেখতে পারি আমরাও। আমি–আপনি সবাই যদি প্রতি মাসে ফরিদপুরের নুরুলের মতো একটি করে ভালো কাজ করতাম, সমাজটা আরও ভালো হতো।