মৌমিতাদের উপাধি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সকাল ছয়টা, ঘড়িতে থেকে থেকে অ্যালার্ম বাজছে। মৌমিতার অ্যালার্ম দরকার হয় না, ওর দেহঘড়িই প্রতিদিন ওকে জাগিয়ে দেয় একই সময়ে। সকাল থেকে রাজ্যের কাজ, সবার নাশতা তৈরি থেকে শুরু করে দুপুরের খাওয়া অবধি একটুও ফুরসত নেই। তার ওপর করোনার জন্য ছুটা বুয়াদের কাজগুলোও নিজের হাতেই করতে হয়। ব্যাপারটা মনে পড়তেই মৌমিতার মনে একটা অন্য রকম রহস্যময় আনন্দ অনুভূত হলো। এক ঝটকায় অ্যালার্মটা বন্ধ করে ওর স্বামী শুভকে জাগানোর চেষ্টা করল, একটু আগেও দুবার ডেকে গেছে ঘড়িতে সাতটা ছুঁইছুঁই, এখন না জাগালে অফিসে দেরি হয়ে যাবে আর উঠে ওর ওপর রাগ করবে।

মৌমিতার বড় ছেলে ঘুম থেকে জেগেই মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আজ কী নাশতা বানিয়েছ মা?’ মৌমিতা ছেলেকে স্নেহভরে কপালে একটা চুমু দিল, ‘আজ তোমার পছন্দের পরোটা।’ এই ছেলেটার পরোটা হলে আর আর কিছু লাগে না। দেখতে দেখতে সবাই টেবিলে হাজির। এবার মৌমিতার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। শাশুড়িমা আদর জড়ানো গলায় বলে, ‘বউমা একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, ঘরটা এখন আগের চেয়ে বেশি গোছানো, বেশি পরিষ্কার। বুঝলে বউমা নিজের কাজ, কাজের লোকেরা কি আর নিজের মতো করে কাজ করে।’

মৌমিতা শাশুড়ির কথায় একটু হাসে, ‘হ্যাঁ মা আপনি ভুল বলেননি। কিন্তু ওরা তো অনেক জায়গায় ঘুরে কাজ করে, তাই সেভাবে পারে না। যাকগে মা, আজ কিছু রাঁধব না ভাবছি। বাচ্চাদের জন্য মুরগি করা আছে আবার সেদিনের মাছটা আছে। শুধু একটু ভাত-ডাল করলেই হবে ভাবছি। আজ টয়লেটগুলো পরিষ্কার করব। আপনাদের ঘরের মশারিটাও ময়লা হয়েছে আর ফ্যানগুলো পরিষ্কার করব। একবারে আমি গোসল করে বেরোব। আপনি একটু দারোয়ানকে ফোন করে বলেন যেন মইটা দিয়ে যায়।’

গোসল সেরে শরীরটা হালকা লাগছে। এরই মধ্য মৌমিতার ছোট্ট মেয়েটা এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরল, ‘মা আমাকে খেতে দাও।’

মাত্র তিন বছর হয়েছে, ভাবখানা এমন যেন সে-ই সবার বড়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, মৌমিতার মনে আজ অন্য কিছু। একটু পরই শুভ ফিরবে অফিস থেকে। এরই মধ্যে কলিং বেলটা বেজে উঠল, শুভর গলা পাওয়া যাচ্ছে। মৌমিতা চুলায় চা চাপিয়ে বাচ্চাদের পড়া দেখিয়ে দিতে গিয়ে চায়ের কথা ভুলে গিয়েছিল। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। পাতিলসুদ্ধ পুড়ে ছাই, শুভ ওর দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, ‘তুমি এত কেয়ারলেস কেন মৌমি?’ আসলেই মৌমিতা মাঝেমধ্যে খুবই কেয়ারলেস, এভাবে করলে সংসার চলে। রাতের খাওয়া সেরে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে এই কাজে সেই কাজে প্রতি দিনই ১২-১টা বাজে, প্রতিদিনই ভাবে, একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাবে, সেটা আর হয় না। মৌমিতা ভাবে, ও আর কী এমন কাজ করে, এগুলো তো সবাই করে বরং ওর মা-শাশুড়ি এর থেকে কত কঠিন কাজ করতেন। মৌমিতার মনে পড়ে আজ ৫ তারিখ। মনে পড়েই ওর চেহারায় একটা গোপন অনুভূতি ছুঁয়ে যায়। এটার একটা কারণ তো অবশ্যই আছে, কারণটা ছোট কিন্তু ওর জন্য বিশাল।

মৌমিতার একটা শখ হলো টাকা জমানো। ওর জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীতে পাওয়া এভাবে-সেভাবে ওর কিছু টাকা জমেছে। সেগুলো সে মাঝেমধ্যেই গুনে দেখে। মৌমিতার শাড়ি, জামা-কাপড়ের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, শুভ যা পছন্দ করে দেয়, তা-ই পরে। কিন্তু এই টাকা জমানোর ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে। ছোটবেলায় সে একবার ২০০ টাকা জমিয়েছিল, সেটা মনে পড়তেই তার হাসি পায়। সেই টাকা কেউ চুরি করে নিয়ে যাওয়াতে সে সারা দিন না খেয়ে ছিল। ওর বাবা রাতে বাসায় ফিরে সেই কথা শুনে মেয়েকে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তার কন্না আরও বেড়ে গেল। ওর সেই জমানো টাকাই চাই। এখনো ওর বাবা মাঝেমধ্যে সবার সামনে এই গল্প করে বসেন।

শুভ মৌমিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাসের বাজারের হিসাবটা লিখেছ?’ শুভ মৌমিতাকে পত্রিকার বিল, ইন্টারনেট বিলটা দিয়ে বলে, এই মাসে ইলেকট্রিক বিল অনেক বেশি এসেছে। মৌমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বলবে?’ নিচের দিকে তাকিয়ে মৌমিতার ছোট্ট উত্তর, ‘না, আপনি বুয়ার বেতনটা দিলেন নাতো।’ শুভ জিজ্ঞেস করে, ‘বুয়া তো গত তিন মাস ধরে নাই?’ মৌমিতা মাথা না তুলেই বলে, ‘তাতে বুয়ার কাজটা তো আটকে থাকেনি?’ শুভ মৌমিতাকে বলে, ‘নিজেকে এখন বুয়ার সঙ্গে তুলনা করা বাকি ছিল।’ মৌমিতা চুপ হয়ে যায়। আসলেই তো, ও কত বোকা, একটু যেন লজ্জা পায়।

শুভ অফিসে চলে যায়। মৌমিতা আজ যেন একটু কাজের খেই হারিয়েছে। দুপুরে খাবার শেষ করে গুছিয়ে উঠতে আজ তিনটা বেজে যায়। মৌমিতার রোজকার রুটিন চলতে থাকে নিয়মের মতো, এই করে সেই করে। এই হলো করোনাকালে মৌমিতার সংসার। মৌমিতারা সংসারের জোয়াল কাঁধে করে টেনে নিয়ে এসেছে এত দূর, এখনো টানছে, ভবিষ্যতেও টানবে। মৌমিতারা বিনিময়ে খেতে পায়, পরতে পায় কিন্তু ওরা কাজের বুয়া না, ওদের উপাধি আছে, ওদের উপাধির নাম সম্মানিত ঘরের বউ।

*উত্তরা, ঢাকা। [email protected]