করোনায় পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্যকে নিয়ে বিপাকে নিম্নবিত্তরা

সারা দিন মুখ দিয়ে লালা পড়ে ১৮ বছর বয়সী মিমের। থাকেন কল্যাণপুর বস্তিতে। মিম কথা বলতে পারেন না, খেতেও পারেন না নিজের হাতে। জন্মের পাঁচ মাসের মধ্যে শনাক্ত হয় তাঁর শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা। সেই থেকে সরকারি চিকিৎসা আর পারিবারিক যত্নে কোনোক্রমে টিকে ছিলেন মিম। করোনা আসায় তাঁর দরিদ্র পরিবারে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, ‘মিমের চিকিৎসার টাকা কোথা থেকে আসবে?’

করোনায় প্রতিবন্ধী মানুষেরা এমনিতেই নানান অসুবিধায় ছিলেন, চিকিৎসার অপ্রাপ্তি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অপারগতা, গৃহবন্দী থাকার সমস্যার পাশাপাশি নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোয় যুক্ত হয়েছে আর্থিক সংকট। যার প্রভাব পড়েছে এসব পরিবারের প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর চিকিৎসায়।

মা জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিম। করোনা জীবিকা হারানোয় জ্যোৎস্না চালাতে পারছেন না মিমের চিকিৎসা। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ
মা জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিম। করোনা জীবিকা হারানোয় জ্যোৎস্না চালাতে পারছেন না মিমের চিকিৎসা। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ

কল্যাণপুর বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশে ১০ বাই ১০ ফুটের ছোট্ট একটা ঘরে বাস করে মিমের ছয় সদস্যের পরিবার। ঘরে এক কোণেই খাওয়ার জায়গা, আরেক পাশে শোয়ার। স্বভাবতই ঘরে টিকতে পারেন না মিম। বস্তিময় ঘুরে বেড়ান, মাঝেমধ্যে পথেও চলে যান। তাঁর মা জ্যোৎস্না বলেন, শরীরের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। কিছু চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় এখন সে কিছুটা সুস্থ। সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে কিছু ওষুধ বিনা মূল্যে পান, বাকিটা কিনতে হয়। করোনার কারণে জীবিকা হারিয়ে এই অর্থের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।

করোনার আগে মিমের মা কয়েক বাড়িতে কাজ করতেন, বাবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। করোনা আসায় দুজনেরই কাজ কমে গেছে। জ্যোৎস্না বলেন, ‘আগে যেখানে আমাদের মাসিক পারিবারিক আয় ছিল সাত-আট হাজার টাকা, তা এখন এসে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার টাকায়। মিমের চিকিৎসা এখন বিরাট বাহুল্য। আবার, ওষুধ ছাড়া রাখাও যায় না মিমকে। ওষুধ বন্ধ হলে আরও অস্থির হয়, ঘুমাতে চায় না। বাড়ির মানুষদের মারধর করে, বাইরে এসে প্রতিবেশী শিশুদেরও মারে।’

প্রতিবন্ধী হাসিবের মা জোগার করতে পারেননি প্রতিবন্ধী ভাতা। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ
প্রতিবন্ধী হাসিবের মা জোগার করতে পারেননি প্রতিবন্ধী ভাতা। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ

বস্তির আরেক কিশোর ১৫ বছর বয়সী হাসিব। মিমের মতো বাকপ্রতিবন্ধী না হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তারও। দুই ছেলেকে নিয়ে হাসিবের মা তাসলিমা একা থাকেন কল্যাণপুর বস্তিতে। স্বামী তাঁকে ছেড়ে গেছেন হাসিবের এক বছর বয়সে। নিজে বাসাবাড়ির কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন, এখন করোনা আসায় তাঁর কাজকর্মও বন্ধ। তাসলিমা বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছি প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে কাগজও জমা দিয়ে এসেছি, কোনো সাড়া পাইনি। এভাবেই ছেলেকে নিয়ে টিকে আছি। জানি না সামনে কী করব!’

হাসিবকে চিকিৎসার জন্য একবার মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নিয়ম, প্রতি রোগীর সঙ্গে একজন পরিবারের সহায়তাকারী থাকতে হবে। হাসিবের মায়ের পক্ষে সম্ভব নয় সর্বক্ষণ হাসিবের সঙ্গে থাকা। তাই তার চিকিৎসার পাট চুকাতে হয়েছে আগেই। সামান্য ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলত তাও এখন অর্থাভাবে বন্ধ। মাঝেমধ্যেই অস্থির হয়ে যায় হাসিব। ঘরের মধ্যে মাথা ঠুকে, নিজেকে নিজে কামড়ায়।

করোনার দারিদ্র্য চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে পারছে না হাসানের পরিবার। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ
করোনার দারিদ্র্য চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে পারছে না হাসানের পরিবার। ৭ জুলাই, ঢাকা। ছবি: মাকসুদা আজীজ

প্রতিবন্ধীদের বিষয় সংবাদ সংগ্রহ হচ্ছে খবর পেয়ে তরুণী লিপি ছুটে আসেন তার সাড়ে তিন বছরের শিশু হাসানকে নিয়ে। হাসানের শরীরের চেয়ে বড় মাথা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, শিশুটি যে হাইড্রোসেফালাস নামক রোগে (মাথায় পানি নিষ্কাশন হতে না পারার কারণে মাথার আকৃতি বড় হয়ে যাওয়া) আক্রান্ত। হাসান জন্মেছিল নির্ধারিত সময়ের আগেই, সঙ্গে ছিল তার যমজ ভাইও। যমজ ভাইটি বাঁচেনি, চিকিৎসকরাও শনাক্ত করেছেন হাসানের মাথা থেকে জলীয় পদার্থ বের হওয়ার পথ নেই। এরপর হয়েছে অনেক চিকিৎসা। দেড় লাখ টাকা খরচ করে একটি অপারেশনের মাধ্যমে হাসানের কানের পাশ দিয়ে তরল নিষ্কাশনের জায়গা তৈরি করা হয়েছে, আরও অপারেশন লাগবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা, পরিবার কুলোতে পারেনি। তিন বছরের হাসান এখনো হাঁটতে শেখেনি। এর ওর কোলে কোলে ঘুরে দিন কাটে তার। তার আদৌ আর কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব কি না সে বিষয়ও নিশ্চিত নয় মা লিপি। করোনার কারণে কাজ হারিয়েছে এ পরিবারটিও।

কল্যাণপুর বস্তির গায়ে গায়ে লাগা ঘরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অসম্ভব। গণশৌচাগার বা গোসলখানায় পাশাপাশি থাকা তো হচ্ছেই, শিশুরাও ঘুরে বেড়াচ্ছে যে যার মতো। মাস্ক পরা বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিষয়টি এখানে বাহুল্য, তাই কেউ কাউকে জিজ্ঞেসও করে না। বস্তিতে কাজ করা একজন স্বেচ্ছাসেবক বিল্লাল বলেন, এখানে কারও যদি জ্বর আসে বা করোনার উপসর্গ হয় কেউ চিকিৎসকের কাছে যায় না। বরং অন্যদের থেকে লুকায় বিষয়টি। তাঁরা ভয় পায় উপসর্গ জানান দিলে প্রতিবেশীরা তাঁদের হয়তো যৌথ সম্পদ ব্যবহার করতে দেবে না।

দরিদ্র এ পরিবারগুলো করোনায় জীবিকা হারিয়ে হয়েছে নিঃস্ব। তাঁদের জন্য সেভাবে আসেনি কোনো সহযোগিতা।