স্কুল জীবনের পর সাতক্ষীরায় যাতায়াত ছিল না সাহেদের

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম
মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম

ঢাকা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিমের পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরায়। তবে স্কুল জীবনের পর সাতক্ষীরায় তাঁর তেমন যাতায়াত ছিল না। সাহেদ করিমের বাবা পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পত্তির মালিক হলেও বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরে একটি ফ্ল্যাট ছাড়া কিছুই নেই। সপরিবারে অনেক আগেই ঢাকা পাড়ি দেন তাঁরা।

সাহেদ করিমের বাবা সিরাজুল করিম। সাতক্ষীরা শহরের সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়কের কামালনগরে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। মা সাফিয়া করিম ২০১০ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ভারত বিভাগের পর সাহেদ করিমের দাদা একরামুল করিম ভারতের বসিরহাট মহকুমা থেকে আসেন সাতক্ষীরায়।

সাতক্ষীরার অধিকাংশ মানুষ সাহেদ করিম সম্পর্কে জানত না। করোনাভাইরাস পরীক্ষাসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে খবর প্রকাশ হওয়ার পর সাতক্ষীরার মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে।

প্রতিবেশী মিজানুর রহমান জানান, সাহেদ তাঁর সহপাঠী ছিলেন। একসঙ্গে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। একই এলাকায় বাড়ি হলেও তাঁর (সাহেদ) সঙ্গে অন্যদের তেমন সখ্য ছিল না। শাহেদ নবম শ্রেণিতে ওঠার পর চলে যান ঢাকায়। শুনেছেন ঢাকায় পিলখানার রাইফেল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছিলেন। তারপর তিনি আর পড়ালেখা করেছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। সাহেদের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না।

সাহেদের আরেক সহপাঠী আইনজীবী রাশিদুজ্জামান জানান, ঢাকায় চলে যাওয়ার পর সাহেদের সঙ্গে তাঁর আর যোগাযোগ হয়নি। সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সাহেদ কারও সঙ্গে মিশতেন না। সাহেদ তাঁর মায়ের সঙ্গে রিকশায় করে আসতেন। স্কুল শেষে তাঁর মা এসে নিয়ে যেতেন। সাহেদের পোশাকও ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। কিছুদিন ধরে তিনি দেখছেন, বিভিন্ন টেলিভিশনে সাহেদ টক শো করছেন। বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন। ৩৬-৩৭ বছরের সাহেদকে দেখলে মনে হয় যেন অনেক বেশি বয়স হয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, সাহেদের দাদার ছিল পাঁচ থেকে ছয় শ বিঘা জমি। বাবা সিরাজুল করিমের চার ভাই। দুই ভাই চট্টগ্রামে ও দুই ভাই ঢাকার মোহম্মাদপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত সিরাজুল করিম মারা যান। আজিজুর রহমান দাবি করেন, ঢাকার পিলখানার রাইফেল স্কুল থেকে শাহেদ এইচএসসি পাস করার পর ধানমন্ডি ভূঁইয়া একাডেমিতে স্নাতকে পড়তেন। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করেছিলেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। ২০০৫ সালে সাতক্ষীরা শহরে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর আচরণে স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন অখুশি হওয়ায় মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। পরে ২০০৭ সালে আবার ঢাকায় বিয়ে করেন সাহেদ। স্কুল জীবন থেকে সাহেদ সাতক্ষীরায় আসতেন না। সর্বশেষ ২০১৬ সালে নলতা পীর সাহেবের কাছে দোয়া নিতে হেলিকপ্টারে করে আসেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতায়। কিন্তু সাতক্ষীরা শহরে আসেননি। ওখান থেকে আবার হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ফিরে যান তিনি।

সাতক্ষীরা শহর ও বিলের জমি বিক্রি করে সাহেদ করিমের বাবা সিরাজুল করিম কামালনগর এলাকার আইনজীবী আবু বক্কর সিদ্দিকের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন ২০০৭ সাল থেকে। কিন্তু সাহেদ কখনো এ বাসায় আসেননি। ঢাকায় কোনো একটা ঝামেলার কারণে ২০১০ সালে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় এসে ওই দিন অবৈধপথে ভারতে গিয়ে বারাসাত এলাকায় সপরিবারে বসবাস করা শুরু করেন তাঁরা। সাহেদের মা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাফিয়া করিম ২০১০ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁর বাবা চলে যান ঢাকায়। পরে ২০১৪ সালে তাঁরা সাতক্ষীরা শহরের সব জমি বিক্রি করে দেন। ২৫ লাখ টাকা দিয়ে শহরের কামালনগরে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। কিন্তু সেখানে তাঁরা কখনো বসবাস করেননি।

সাতক্ষীরা শহরের কাজী সালাহউদ্দিন জানান, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে সাহেদ করিম ডিবিএস নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেন ২০০৯ সালে। সালাহউদ্দিন ওই প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। কখনো তাঁকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবার কখনো চেয়ারম্যান পদ দেওয়া হতো। তিনি বলেন, এক টাকাও বেতন না দেওয়ায় দুই বছর পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসেন। তিনি বলেন, সাহেদ একটা পচা ডিম। তাঁর কাছ থেকে ২৯ লাখ টাকার ফার্নিচার নিয়ে এক টাকাও দেননি। শুধু তা–ই নয়, কুরিয়ার সার্ভিসের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর ষোলো আনা পাপ পূর্ণ হওয়ায় করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, সাহেদের মা সাফিয়া করিম আমৃত্যু সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর পরিবারের অন্যরা কেউ সাতক্ষীরায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। শাহেদ করিমও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না কখনো।

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সাহেদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা শহরের কামালনগরে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় কোনো মামলা নেই।