একজন গৃহিণীর কর্মহীন জীবনের কর্মব্যস্ততা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

কর্মহীন এই অর্থে যে আমার কোনো ক‍্যারিয়ার হয়নি। মানে নো ক্যারিয়ার, নো আইডেনটিটি। মেয়েদের নিয়েই আমার যত ব‍্যস্ততা।

বড় মেয়ের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন ছোট মেয়ের জন্ম। ঢাকায় একক পরিবারে সারা দিন দুজনের দেখাশোনা করে কীভাবে যে সময় পার হতো, বুঝতেই পারতাম না। একে খাওয়াচ্ছি, তো ওর ন‍্যাপি চেঞ্জ করছি। একজন ঘুমাচ্ছে, তো অন্যজন জেগে। একজন জ্বর থেকে সেরে উঠল তো অন্যজনের তাপমাত্রা বাড়ল। সবচেয়ে বেশি বিপদ হতো যখন কাজে সাহায্যকারী মেয়েটি ছুটিতে থাকত। সারা দিন অপেক্ষায় থাকতাম কখন ওদের বাবা কাজ শেষে ঘরে ফিরবে। তার কাছে মেয়েদের রেখে তবেই করব আমার গোসল বা রান্নাবান্না।

বড় মেয়েকে বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল প্রভাতি শাখায় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করলাম। এই স্কুলের ঠিক পেছনেই বেইলি রোডের অফিসার্স কোয়ার্টার। এই আবাসিক এলাকায় বেইলি প্রিপারেটরি স্কুলে ছোট মেয়েকে নার্সারিতে ভর্তি করি। যাতে দুই মেয়েকে একই সঙ্গে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে পারি।

তখন আমরা রামপুরায় থাকতাম। মেয়েদের টিফিন, নিজের জন্য নাশতা, এসব রেডি করে সকাল সাতটার আগেই বাসা থেকে বের হতাম। একটা নির্দিষ্ট রিকশা ঠিক ছিল, সেটা যথাসময়ে গেটে অপেক্ষা করত। সাড়ে সাতটায় স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে গেলে আর মেয়েকে ঢোকানো যাবে না, এটা মাথায় রেখেই তৎপর থাকতে হতো।

দুই মেয়ের স্কুলে অ্যাসেম্বলি শেষ হলে, অর্থাৎ মাইকের আওয়াজ থামলে শুরু হতো আমার পড়াশোনা। ইতিমধ্যে ল ইয়ার সাহেবের ব্রেইন ওয়াশে ল ভর্তি হয়েছিলাম। অফিসার্স কোয়ার্টারের গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে অনেক অভিভাবক বসতেন। তাঁদের থেকে আলাদা বসে চলত পড়াশোনা। অনেস্টলি স্পিকিং, তখন পড়াশোনা করতে আমার ভালোই লাগত। এ সময় এবং মেয়েরা ঘুমানোর পর রাতে পড়া, এভাবে ল দুই পার্ট পাস করলাম। এরপর ল ইয়ার সাহেব যখন বার কাউন্সিল পরীক্ষার জন্য পেপার নিয়ে এল, তখন আর পরীক্ষা দিতে ইচ্ছা করেনি। মনে হলো এটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আসলে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই হয় না। যাহোক, এটা অন‍্য প্রসঙ্গ।

বড় মেয়ের স্কুল ছুটির এক ঘণ্টা আগে ছোট মেয়ের ছুটি হতো। এটুকু সময় ছোট মেয়েকে নিয়ে খেলাধুলা। এরপর দুজনকে নিয়ে বেলা একটা নাগাদ বাসায় ফিরতাম। এবার তাদের ঝটপট গোসল, খাওয়া সেরে আরবি শিক্ষকের কাছে পড়া শেষ করে ঘুম। বিকেলে ছাদে অন‍্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা। সন্ধ্যায় দুই মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসা।

বড় মেয়ে যখন ক্লাস ফাইভে, তখন বাসা শিফট করে আমরা সিদ্ধেশ্বরী আসি। ইতিমধ্যে ছোট মেয়েকে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ভর্তি করেছি। ওর সময় থেকে দেশে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি শুরু। লটারিতে না আসায় ভিকারুন্নিসায় ভর্তি করা যায়নি।

এখন বাসা স্কুলের কাছে হওয়ায় আমার চাপ কমে যায়। দুজনকে স্কুলে পাঠানোর পর্ব শেষ করে হাঁটতে যেতাম কখনো রমনা পার্কে, কখনো বেইলি রোডের অফিসার্স কোয়ার্টারে। কিন্তু নিজেকে কর্মহীন মনে হতে লাগল। এ সময় ছোট মেয়ের বন্ধুদের পড়ানোর প্রস্তাব আসে। ভালোলাগার জন্য পড়াতে শুরু করি। এতে আরেকটা উপকার হলো, ছোট মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত বসা হচ্ছে এবং সে তার বন্ধুদের সঙ্গে পড়তে আনন্দ পায়।

ক্লাস সিক্স থেকে বড় মেয়েকে আর পড়াইনি। সে স্কুল ছুটির পর ব‍্যাচে কোচিংয়ে পড়েছে, বাকিটা নিজে। সে বরাবরই ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। ছোট অতটা পরিশ্রম করতে পারে না। তাই ক্লাস এইট পর্যন্ত আমিই ওকে ঘরে পড়িয়েছি। ক্লাস নাইনে এসে ছোট মেয়ে ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। দিনের বেলায় ছোটকে স্কুলে আনা-নেওয়ার অবসরে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস ও ভিকারুননিসার কিছু মেয়ে পড়তে আসে। আর রাতে ছোট মেয়ের পড়াশোনা দেখা। এভাবে কর্মব্যস্ত সময় কেটেছে।

আমি প্রাণিবিদ্যায় অনার্স, মাস্টার্স এবং পরে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েও শুধু মেয়েদের ভাবনায় কিছু করে উঠতে পারিনি। ওদের নিরাপত্তা, ওদের ভালো থাকা আমার কাছে পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

এখন এই করোনা পরিস্থিতিতে বড় মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক ও ছোট মেয়ে এসএসসিতে এসে থেমে আছে। মহান আল্লাহ যেন এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটান। আল্লাহর কাছে এটুকুই চাওয়া, আমার মেয়েরা যেন প্রকৃত মানুষ হয়। আর আমার মতো শুধুই ‘হাউস ওয়াইফ’ পরিচয়ের বাইরে ওদের যেন একটা আইডেনটিটি হয়, ওদের যেন একটা নিজস্ব পরিচয় থাকে।


*সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা। [email protected]