করোনাকালে প্রাণীরা ক্যাম্পাসে ফিরছে

সোনালি ডানার সরালিরা শীতের সাময়িক অতিথি হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে কেউ কেউ। পছন্দের কাউকে নিয়ে জোড় বেঁধে এলোমেলো উড়ে বেড়ায় আকাশময়। কিচিরমিচির শব্দে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলে।

মানুষের পদভারে ওষ্ঠাগত ক্যাম্পাসে করোনা এই সরালির জীবনেও নিয়ে এসেছে সুসময়। নির্জন প্রকৃতিতে এবার ডজনখানেক সরালি দম্পতি ঘর বেঁধেছে এই ক্যাম্পাসে। কয়েকটি সরালি দম্পতির কোলজুড়ে ইতিমধ্যে ছানাও এসেছে।

আলাদিনের চেরাগের মতো করোনা তাবৎ পৃথিবীর মানুষকে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। এই ক্যাম্পাসও তার বাইরে নয়। শিক্ষার্থীরা হল ছেড়েছে, ক্যাম্পাসবাসীর চলাচলও সীমিত। সেকালের পায়ে ঠেলা রিকশা আর একালের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ঠেলায় যে রাস্তায় চলাফেরা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিল, সেই রাস্তাঘাটে নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বর্ষার বিরামহীন বৃষ্টি। এই সুযোগে প্রাণ-প্রকৃতি সেজেছে বাহারি রঙে। প্রকৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বুনো প্রাণীর দল যেন নিজের জায়গার মালিকানা ফিরে পেয়েছে। নিশাচর শিয়াল এখন দিনের বেলায় নিরাপত্তাপ্রহরীর প্রতিবেশী। এরাও যেন ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। অন্যদিকে অঢেল আম–কাঁঠালের ইজারা নিয়েছে বাদুড় আর কাঠবিড়ালির দল। 

কোথা থেকে ভেসে আসে ডাহুকের ডাক, কবির এই ডাহুক পাখির ডাক এখন আর দূর থেকে ভেসে আসতে হয় না, রাতবিরাতে ঘরের আশপাশেই শোনা যায়। জোনাকির দল আলো ছড়াতে ইট–পাথরের বসতঘরে ঢুকে পড়ে। এমন জানা–অজানা নানা প্রাণীর স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ করোনার করুণা কি না কে জানে।

করোনায় আমরা যখন হতবিহ্বল, প্রকৃতি তখন মেলেছে ধরেছে তার অপরূপ সৌন্দর্য।

বনবিড়ালের ফিরে আসা
বনবিড়ালটি সপ্তম ছায়ামঞ্চের পাশে মার্বেল পাথরে বাঁধাই করা বেঞ্চে গিয়ে বসল। ভাবতেই পারিনি, বিড়ালটি ওখানে গিয়ে বসবে। বসে কয়েকবার পায়ের গোড়ালি চেটেপুটে নিল, যেমনটি বাড়ির পোষা বিড়াল করে থাকে। এরপর আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অদ্ভুত মায়াবী সে চাহনি। এভাবে মিনিটখানেক বসে থাকল। পরক্ষণেই এক লাফে পাশের ঝোপে গিয়ে আবার বসে পড়ল। বাঁয়ে মোড় নিয়ে আমরাও খানিকটা এগিয়ে গেলাম। আড়চোখে আমাদের দেখছে বিড়ালটি। কোনো ডর-ভয় নেই।

জুনের প্রথম সপ্তাহ। পশ্চিমের রাধাচূড়া ভেদ করে পদ্মপাতার ওপর বিকেলের সূর্যের আলো তখনো চিকচিক করছে। সবে গোছল সেরে এক জোড়া সরালি গায়ের পালকের ফাঁকে ফাঁকে ঠোঁট চালিয়ে দিচ্ছে, সেই দৃশ্যের ছবি তুলছে সাইফ, অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া আমাদের ছেলে। 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত করছি। কয়েক বছর আগে ক্যাম্পাসের দক্ষিণের এক জঙ্গলে এক গোধূলিবেলায় এই বনবিড়ালের দেখা পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালো ছবি তোলার সুযোগ দেয়নি। অথচ করোনাকালের এই সময়ে বনবিড়ালের এমন আচরণ আমাদের শুধু অবাকই করেনি, মুগ্ধও করেছে। বিড়ালটির বসে থাকার হাবভাবে মনে হলো, ও আমাদেরকে বলছে, ‘তোমাদের ছবি তোলা শেষ হয়েছে?’ 

বোকা সরালির দম্পতি
জুনের ২০ তারিখ সকাল নটা-দশটা হবে। এক সহকর্মীর ফোন এল, অপ্রত্যাশিতই বলা যায়। জানালেন, সরালির একটি বাসা থেকে তিনটি ছানা নিচে পড়ে দুটি মারা গেছে, একটি বেঁচে আছে। ঘটনাস্থল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট অফিসের কাছে সুপারিতলা। দ্রুত পৌঁছে যাই সেখানে। রাস্তার ঠিক ওপরে একটি মেহগনিগাছের মগডালে সরালির বাসাটা। সরালির বাসা ইতিপূর্বে ক্যাম্পাসের ঝোপঝাড়সমৃদ্ধ এলাকায় বেশি দেখেছি। বাসা বানাতে এরা সাধারণত নির্জন ঝোপঝাড় এলাকা বেছে নেয়। কারণ, ডিম ফুটে ছানারা বের হলে একে একে বাসা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে। নিচে ঝোপঝাড় থাকলে ছানারা আহত হয় না। নেমে এলে নিচে অপেক্ষারত মা-বাবা ছানাদের পথ দেখিয়ে পাশের কোনো জলাশয়ে চলে যায়। আর এই বোকা সরালি দম্পতি বাসা বানিয়েছে রাস্তার ওপরে। করোনাকালের নির্জনতা হয়তো সরালি দম্পতিকে এমন জায়গায় বাসা গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। নিচে পিচঢালা রাস্তা হওয়ায় লাফিয়ে পড়ে দুটি ছানা তৎক্ষণাৎ মারা যায়। 

শীতে আসা জলমোরগ গ্রীষ্মে
মা পাখিটা ছটফট করছে। অস্থির হয়ে এদিক–ওদিক ছুটছে। কিন্তু দূরে সরে যায় না। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ওর এই উদ্বেগ। বুঝতে বাকি রইল না। পাখিটি হয়তো কাছাকাছি কোথাও বাসা বেঁধেছে। তবে হিসাবটা মিলছে না ঠিকঠাক। জলমোরগের তো বাসা বানানোর কথা নয় এই ক্যাম্পাসে। এত দিন শীতেই দেখেছি ওদের। শীতের শেষে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। এই যখন ভাবছি, তখন আমাদের অবাক করে দিয়ে পাশের কচুরিপানা থেকে বের হয়ে এল লাল ঠোঁটের কালচে একটি ছানা। মায়ের মুখ থেকে খাবার নিয়ে কচুরিপানায় আবার হারিয়ে গেল। বেশ চটপটে। আমরা গাছের আড়ালে সরে এলাম। মা এদিক–ওদিক ভালো করে দেখে নিল। একপর্যায়ে আমাদের দেখতে না পেয়ে মা কচুরিপানা থেকে ছানাটি খোলা জায়গায় বের করে নিয়ে এল। ছানাটি মায়ের পিছু পিছু ছুটল। নিজেও মাঝেমধ্যে জলজ উদ্ভিদের ডালাপালা পরখ করছে। তবে মায়ের দেওয়া খাবারই মুখে তুলছে বেশি। টুকটাক শব্দও করছে। শিখছে মায়ের ভাষা, বেঁচে থাকার কলাকৌশল।

জলমোরগ জলচর পাখি। কচুরিপানা বেশ পছন্দের আবাস। প্রতিবছর শীতকালে কয়েক জোড়া জলমোরগ আসে স্বল্পকালীন অতিথি হয়ে এই ক্যাম্পাসে। শীতের পুরো সময়টাই লেকে ঘুরে বেড়ায়। শীতকালের শেষ ভাগে যখন সরালিরা একে একে ছেড়ে যায় ক্যাম্পাস, তখন জলমোরগও প্রস্তুতি নেয় বাড়ি ফেরার। অনেকটা সরালির মতো। কিন্তু করোনাকালে প্রকৃতির হিসেবটাও কেমন যেন বদলে গেছে। শীতের পরিযায়ী জলমোরগও এবার ছানা তুলেছে এখানে। তেমন কোনো উৎপাত না হলে ক্যাম্পাসের জলাশয় নিশ্চয়ই এদেরও স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠবে।

সন্ধ্যায় ডোরাকাটা বাগডাশ
জুনের শুরুর দিকের ঘটনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলছিলাম। সন্ধ্যা নামার কিছুটা পরপর হবে। প্রান্তিক গেটের কমিউনিটি জামে মসজিদের ঠিক উল্টো দিকে বড় রাস্তা–লাগোয়া আমাদের বাসা। হঠাৎ চোখে পড়ল, বাসার সামনের বাগানে ভাবলেশহীন হেঁটে চলছে সাদা-কালো ডোরাকাটা একটি বড় আকারের প্রাণী। বাসার গেটের লাইটের আলোতেও কোনো লুকোচুরি ভাব দেখলাম না নিভৃতচারী প্রাণীটির মধ্যে। ছোটবেলায় গ্রামের মানুষকে পিটিয়ে মারতে দেখেছিলাম একবার, তা–ও প্রায় ৩০ বছর আগে। এরপর প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখিনি অত্যন্ত সতর্ক এই বুনো প্রাণীটিকে। এটি আমাদের বড় বাগডাশ। হঠাৎ করে এমন অপ্রত্যাশিত প্রাণী দেখে আমার চোখ আটকে যায়। ফোনের ওপাশ থেকে যখন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার কথা বলছিস না কেন, তখন আমি সংবিৎ ফিরে পাই। বেশ কয়েক দিন বাগডাশটি একই সময়ে একই পথ ধরে চলাচল করে।

ক্যাম্পাসে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে আছি। প্রথমে প্রাণিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে, পরে শিক্ষকতায়। এই দীর্ঘ সময়ে ক্যাম্পাসে নানা বুনো প্রাণী দেখেছি, ছবি তুলেছি। কিন্তু ইতিপূর্বে বাগডাশের দেখা পাইনি। করোনাকালে এই বিশেষ প্রাণীটি দেখে তাই চমকে উঠি। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যি দেখছি তো? খুব পরিচিত প্রাণী হলেও এর দেখা পাওয়া অনেকটা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

করোনাকালে দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট ও কেলেঙ্কারির খবর দেখে মনে হয়েছে, প্রকৃতিতে বিনা মূল্যে যে অক্সিজেন ছড়িয়ে আছে, তা আমরা কীভাবে ধ্বংস করছি। নির্মল বাতাস আজ আমাদের নানা দূষণে ভরপুর। তাই আশঙ্কা জাগে, প্রাণ–প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে চলাফেরা করতে হয় কি না। করোনাকাল একদিন বিদায় নেবে। মানুষ আবার পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে। করোনা আমাদের যে বার্তা দিয়ে গেল, তা আমরা আগামীকাল মনে রাখব না ভুলে যাব, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।