বুক ফাটা কোয়ারেন্টিন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

স্কুলজীবন থেকেই গল্প-কবিতা লেখার অভ্যাস আমার, তাই সময় পেলেই নতুন কিছু লিখতে বসতাম, যেদিন থেকে কোয়ারেন্টিন শুরু হলো, ভেবেছিলাম এই সুযোগে বেশ কয়েকটি গল্প লিখতে পারব। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্য আমি সবার ছোট আর আদরের বলে লেখাপড়া ছাড়া গল্প লেখাটাই একমাত্র কাজ। বাকি দিকগুলো তারাই সামলে নেয়।

একদিন সকালে নামাজ শেষে গল্প লিখতে বসেছিলাম, হঠাৎ একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে, অল্প একটু বিরক্ত বোধ করেই ফোনটা রিসিভ করলাম, কুশল বিনিময় করার পর প্রতিপক্ষের বক্তব্য শুনে আমার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়, বাইরে হয়তো বিদ্যুৎ চমকায়নি, আকাশ মেঘাচ্ছন্নও হয়নি। কিন্তু আমার ভেতরে যে একটি আচমকা ঝড় উঠেছিল, সেটি বাহ্যিক প্রকৃতিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে আমাকে বিচলিত করে তোলে, আর সেই খবরটি হলো, ‘আপনার বড় ভাই আমির হোসেন এখন রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি আছে, ওনার করোনা পজিটিভ আসছে।’

আমার বাবা হার্টের রোগী। মাও কিছুটা অসুস্থ। আমি মা-বাবাকে কিছু না জানিয়ে, গোপনে মেজ ভাইয়ের সঙ্গে কথাটি শেয়ার করি। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার ভেতরের ঝড়ের কবল থেকে তিনিও ছাড় পাননি! কান্না থামিয়ে তিনিও মা-বাবার কাছ থেকে বিষয়টা গোপন রাখার কথা বলেন, কারণ হয়তোবা তাঁরা এটি সহ্য করতে পারবেন না।
কিন্তু আমরা নিজের থেকে মা-বাবাকে কিছু না জানালেও, প্রতিদিন নামাজের পর তাঁদের কান্নাকাটি দেখে মনে হতো কোনো এক ফেরেশতা হয়তো তাঁদের সব জানিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে সন্তানের বিপদে মা-বাবা সবার আগে খবর পান, তাও অদৃশ্যভাবে, এটি তারই একটি প্রমাণ!

এদিকে কিছুদিন পর মায়ের মোবাইলে আরও একটি ফোন আসে, কল শেষে মায়ের প্রেশার বেড়ে গেলে বিছানায় শুয়ে পড়েন। দৌড়ে চিকিৎসক নিয়ে এলাম। কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে মায়ের কান্না থামার কোনো রকম সান্ত্বনা পেলাম না। অনেকক্ষণ পর মা যখন নামাজে দাঁড়ালেন, তখন আমি মায়ের মোবাইলটা হাতে নিই। কল রেকর্ড অন ছিল। রেকর্ড অন করতেই অন্য দিক থেকে মামানির কান্না ভেজা কণ্ঠে ভেসে এল, ‘আপনার ভাইয়েরও করোনা পজিটিভ আসছে, তিনিও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুমনের পাশের কেবিনেই আছে।’

শকটা এখানেই হয়েছে, একই সঙ্গে ছেলে ও ভাই দ্বিতীয়জনের করোনার কথা শুনে সেই শক সামলে উঠতে পরেননি। প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল! বাবারও যেন একই পরিস্থিতি, কাকে রেখে কাকে নিয়ে ভাবব, তা নিয়ে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একদম নিশ্চুপ, ভেঙে পড়েছিলাম। প্রতিটি মুহূর্ত যেন কাটছিল বছরের মতো বুক ভরা কষ্টসংবলিত।

সবার সম্মিলিত প্রার্থনার পর প্রায় দুই মাস পরে শুভ সংবাদ শুনতে পেলাম। ভাইয়ের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তার কিছুদিন পরই মামাও সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। তখনকার আনন্দ যে আমাদের কত বড় পাওয়া, সেটি লিখে কিংবা প্রকাশ অসম্ভব!

কোয়ারেন্টাইন জীবন এই দুশ্চিন্তা আর টেনশনে কাটাতে হলো। গল্পও লিখতে পারিনি আর পড়াশোনা তো অনেক দূরের কথা! আজ সেই পড়ার ঘাটতি টানতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। আর সব থেকে বড় পাওয়া আমাদের পরিবার আবারও আগের মতো হয়েছে, আজ আমাদের একটাই চাওয়া, কখনো যেন আমাদের এই পারিবারিক বন্ধনে কোনো ধরনের ভাঁজ না পড়ে...।

*লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান, সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয়, সায়দাবাদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া