গরু উদ্ধারের ভিডিও ছেড়ে সমালোচনার মুখে ওসি

আটক মিজানুর রহমানকে দেখিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন ওসি জিয়াউল আহসান। ওসির ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি।
আটক মিজানুর রহমানকে দেখিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন ওসি জিয়াউল আহসান। ওসির ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি।

বরিশালের উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ভিডিও নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। ভিডিওটি চুরি যাওয়া একটি গরু উদ্ধার, চুরির কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার জব্দ ও একজনকে আটকের ঘটনা নিয়ে। সমালোচকেরা বলছেন, সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ব্যক্তিকে নিয়ে এমন ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে ওসি আইনের লঙ্ঘন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করেছেন।

জানতে চাইলে উজিরপুর মডেল থানার ওসি জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিনব পদ্ধতিতে গরু চুরির ঘটনাটি মানুষজনকে জানাতে আমি এভাবে ভিডিও করে ফেসবুকে প্রচার করেছি। আমি কোনো আইনের লঙ্ঘন করিনি। মানুষকে সচেতন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের প্রচারণা চালানো আইনসিদ্ধ।’

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সোমবার ভোররাতে উজিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জাফরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ উপজেলার জয়শ্রী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিল। এ সময় পুলিশের গাড়ি দেখে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো খ-১২-৪২৬০) স্থানীয় সাজু ফিলিং স্টেশনের কাছে থেমে যায়। এতে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশ গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলে তিন ব্যক্তি দৌড় দেন। তখন পুলিশ ধাওয়া করে একজনকে ধরে ফেলে। তিনি গাড়িটির চালক মিজানুর রহমান (৩৫)। পরে প্রাইভেট কারটির ভেতরে বড় আকৃতির একটি গাভি পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ধীরে ধীরে এলাকার অনেকে সেখানে জড়ো হন। তখন জয়শ্রী গ্রামের ওমর ফারুক সেপাই (৫০) এসে বলেন, গরুটি তাঁর। রাতের আঁধারে সেটি চুরি হয়েছিল। পরে ওমর ফারুক বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। আটক হওয়া মিজানুর রহমানকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে তাঁকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

এদিকে গরুটি উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করা হয়। সেটি পরে নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেন ওসি জিয়াউল আহসান। ভিডিওটির শুরুর দিকে দেখা যায়, সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার। তার পাশে কালো রঙের একটি গাভি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন। তাঁকে গরুটির মালিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন ওসি জিয়াউল আহসান। এরপর ক্যামেরা ধরা হয় আটক হওয়া মিজানুর রহমানের দিকে। প্যান্ট ও গেঞ্জি পরিহিত মিজানুরের দিকে হাত নেড়ে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘গরুটি চুরি করেছিলেন এই ভদ্রলোক।’ এ সময় মিজানুর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে সাদা রঙের গাড়িটি ও এতে করে গরুটি চুরির কৌশল নিয়ে আরও অনেক কথা বলেন ওসি। আশপাশে পুলিশ সদস্যসহ আরও পাঁচ-ছয়জনকে দেখা যায় ভিডিওটিতে।

ওসির ফেসবুকে ভিডিওটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়। ওসির ফেসবুকে ভিডিওটির নিচে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ১৮৮টি মন্তব্য এসেছে। আর এটি ‘শেয়ার’ করেছেন ২৩৭ জন। সেখানে যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁরা ওসিকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। কিন্তু অন্য যাঁরা ভিডিওটি ‘শেয়ার’ করেছেন, সেখানে ভিডিওর নিজে অনেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। একজন লিখেছেন, ওসি বানোয়াট একটা গল্প বানিয়ে ফেসবুকে ছেড়েছেন। কেউ কেউ আবার এত বড় একটা গরু প্রাইভেটকারের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। তাঁদের মতে, বিষয়টা যদি সম্ভবই হবে, তাহলে গাড়ির ভেতরে গরুটি থাকা অবস্থায় ভিডিও ধারণ করা হয়নি কেন?

আর মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, কোনো অপরাধের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কেউ আটক হওয়া মানেই তিনি অপরাধী নন। আদালতের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সাজাপ্রাপ্ত না হলে কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। এটা আইনেই স্পষ্ট করা আছে। ফলে একজনকে আটকের পর এভাবে ভিডিও করা ও তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করা আইনসিদ্ধ নয়। এই বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও মানবাধিকার সংগঠক মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, উজিরপুর মডেল থানার ওসি এটি করে থাকলে তিনি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। সুপ্রিম কোর্টও অপরাধের ঘটনায় আটক ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কোনো ছবি বা ভিডিও গণমাধ্যম বা অন্য কোথাও না প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন। ভিডিওটি ফেসবুকে প্রকাশ করে থাকলে ওসি সেই নির্দেশ অমান্য করেছেন। ওই ব্যক্তি নিরপরাধ হয়ে থাকলে ওসির বিরুদ্ধে মানহানির মামলাসহ অন্যান্য আইনি আশ্রয় নিতে পারবেন।