গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নাম গায়েব

মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর
মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর

৪.
অভিযোগ ও হুমকি
পুলিশের সিআইডি বিভাগের সহকারী সুপার আবুল কাহার আকন্দ ২৭ জুন ১৯৯৫ জেনারেল এইচ এম এরশাদ ও আরও চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন। তাঁরা হচ্ছেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল লতিফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামালউদ্দীন ভূঁইয়া (মেজর কামাল নামে পরিচিত), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শামসুর রহমান শামস ও মেজর (অব.) কাজী এমদাদুল হক (ক্যাপ্টেন এমদাদ নামে পরিচিত)।
মেজর জেনারেল আবদুল লতিফকে এতে সম্পৃক্ত করা হয় দৃশ্যত সিআইডির কাছে দেওয়া চট্টগ্রামের তত্কালীন ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের (ডিপিসি) সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। সিআইডির কাছে তিনি বলেছিলেন:
‘খবর পাওয়া যায় যে, জেনারেল মঞ্জুর তাঁর কতিপয় সঙ্গী ও পরিবারসহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং তাঁদের হাটহাজারী থানার দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। কমিশনার সিএমপি [চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ] সাহেব সাথে সাথে এ সংবাদ আইজিপি মহোদয়কে জানান। সন্ধ্যার পরে জানা যায়, তাঁদের হাটহাজারী থানায় আনা হয়েছে। রাত্রি আনুমানিক নয়টার সময় কমিশনার সিএমপি সাহেবের নির্দেশে সেনানিবাস থেকে হাটহাজারী থানায় প্রেরিত সেনা অফিসারের সঠিক পরিচয় যাচাই করার জন্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইবিআরসির [ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার] কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজকে টেলিফোন করি। তিনি [ব্রিগেডিয়ার আজিজ] জানান যে, সেনাপ্রধানের নির্দেশক্রমে আটককৃতদের [জেনারেল মঞ্জুরসহ অন্যান্য কর্মকর্তা] সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তরের জন্য তিনি ও ব্রিগেডিয়ার লতিফ [বর্তমানে মেজর জেনারেল] ক্যাপ্টেন এমদাদকে হাটহাজারীতে পাঠিয়েছেন। তাঁর [ব্রিগেডিয়ার আজিজের] নিকট জেনারেল মঞ্জুরসহ সকলকে হস্তান্তরের জন্য বলেন। আমি বিষয়টি কমিশনার সাহেবকে জানালে তিনি সে মতে হাটহাজারীতে এমপি চট্টগ্রাম ও ডিআইজি রেঞ্জ চট্টগ্রামকে ওয়্যারলেসে জানিয়ে দেন।’ (গুরুত্ব আরোপের জন্য বাঁকা হরফ ব্যবহার করা হলো)
এ সাক্ষ্যের গুরুত্ব অনেক। কেননা, চট্টগ্রামের পুলিশের তত্কালীন ডেপুটি কমিশনার (ডিপিসি) সে রাতের ‘বিশেষ অভিযান’-এ ‘চেইন অব কমান্ড’-এর কিছু বিশেষ সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। জেনারেল মঞ্জুরের গ্রেপ্তারের পর ব্রিগেডিয়ার আজিজকে স্বল্প সময়ের জন্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সিআইডিকে দেওয়া ডিপিসির ভাষ্য অনুযায়ী, ব্রিগেডিয়ার আজিজ নাকি জানান যে ক্যাপ্টেন এমদাদের নেতৃত্বে যে সেনা ইউনিট হাটহাজারী থানা থেকে মঞ্জুরকে আনতে রওনা দিয়েছে বা এরই মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে, তারা মূলত ব্রিগেডিয়ার আজিজ ও ব্রিগেডিয়ার লতিফের (পরে মেজর জেনারেল) নির্দেশে কাজ করছে। এ দুই কর্মকর্তা আবার ‘সেনাপ্রধানের (এইচ এম এরশাদের) নির্দেশক্রমে’ কাজ করছেন।
দৃশ্যত ইকবালের সাক্ষ্য এবং সিআইডি ও আমিনুলের হাতে আসা তথ্য-প্রমাণ অনুসারে ব্রিগেডিয়ার লতিফের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছে। [১৯৮১ সালের পরে এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে ব্রিগেডিয়ার লতিফ সেনা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৯৫ সালে তাঁকে মঞ্জুর হত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়]।
সব সাক্ষ্য অনুসারে, মঞ্জুরকে হস্তান্তর করার বেঁচে থাকার মতো আর সামান্য কিছু ঘণ্টা তাঁর সামনে ছিল। সুবেদার-১-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন এমদাদ তাঁর সহকর্মীদের বলেন, এ অভিযানে মঞ্জুর তাঁদের আয়ত্তে আসা মাত্রই তাঁকে শেষ করে দিতে হবে। তাঁরা সেনাবাহিনীর ‘ওপরের নির্দেশ’ অনুযায়ী কাজ করছেন।
যেসব সাক্ষ্য আমরা দেখলাম এবং সিআইডির হাতে যা আছে তার ভিত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ও সিআইডি মঞ্জুর হত্যা মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করার সিদ্ধান্ত নেয়: এরশাদ, লতিফ, কামাল, শামস ও এমদাদ।
এ মামলার নথিগুলো বিস্তারিতভাবে দেখার সময় প্রথম সপ্তাহে আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয়, কী কী বিষয় এই লোকগুলোকে একই সূত্রে গেঁথে রেখেছে?
আজ ১৯ বছর পর ২৩ জন বিচারক ও অজস্র কৌঁসুলি পাল্টানোর পর যে সূত্রটি এই পাঁচজনকে গেঁথে রেখেছিল, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। প্রথিতযশা যেসব সাংবাদিক ও আইনজীবীকে আমি এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছি, তাঁরা কিছুই জানেন না। এ প্রশ্নের উত্তর তাঁদের জানা নেই, ‘কেন এই পাঁচজন কর্মকর্তা? এরশাদের সঙ্গে কেন বাকি এই চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে?’
অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ও সিআইডি ১৯৯৫ সালে এই পাঁচজন সৈনিক ও পুলিশের ডেপুটি কমিশনারের যে সাক্ষ্য নিয়েছিলেন, তার মধ্যেই উত্তরটি নিহিত রয়েছে।
এই পাঁচজন ‘মঞ্জুর হত্যা মামলার’ আসল সম্মিলিত অভিযুক্ত ব্যক্তি। সে কারণে আদালতে শুনানি চলাকালে তাঁদের তিনজন—এরশাদ, কামাল ও এমদাদ—পাশাপাশি বসেন। কোনো এক অজানা কারণে উচ্চ আদালত বেশ কয়েক বছর আগে মেজর জেনারেল আবদুল লতিফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমানের বিচারিক-প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছেন। এই স্থগিতাদেশ এবং আরও কিছু প্রশ্ন এ মামলার বিচারিক প্রশাসনকে ঘিরে বিগত ১৯ বছর ধরে এক ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি আবার মঞ্জুর হত্যা মামলার সূচনা হয়েছে। বিশেষ কৌঁসুলি আসাদুজ্জামান খান আদালতে বলেছেন, ‘অভিযোগপত্রে কিছু ত্রুটি আছে’ এবং তদন্ত ‘অসম্পূর্ণ’। প্রায় ২০ বছর পর উল্লেখযোগ্য একটি বিবৃতিই বটে। তদন্ত শেষ হতে আর কত সময় লাগবে? আরও ১০ বছর?
কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর নাম যে বাদ পড়েছে, কৌঁসুলি তার কারণ ব্যাখ্যা করেননি। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি কিবরিয়াকে আদালতে কখনো ডাকাই হয়নি, যদিও এরশাদকে অভিযুক্ত করে তাঁরা সিআইডির কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁদের নাম কি সাক্ষীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে?
এটি সত্য হলে আমরা সাক্ষী জালিয়াতির এক উত্কৃষ্ট ও সৃষ্টিশীল নমুনা দেখলাম। কেউ একজন কারসাজি করে তালিকা থেকে এই সাক্ষীদের নাম হাওয়া করে দিয়েছেন (কোন বছর ও কার আমলে তাঁদের নাম বাদ পড়ল, সেটা জানতে পারাও বেশ চিত্তাকর্ষক হবে)।
২০ বছর পর কে খেয়াল করে দেখবে তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নাম বাদ পড়ে গেল কি না? কীভাবে তা ঘটল? তা করতে গিয়ে কী ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল?
এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি এ মামলার ২৩তম বিচারক খন্দকার হাসান মাহমুদ ফিরোজ কৌঁসুলির কাছ থেকে এ তথ্য জানতে পেরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। একে তিনি ব্রিবতকরও বলেছেন। তিনি এ মামলা পুনঃ তদন্তের এবং সিআইডিকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। এই তদন্ত নতুন কী উদ্ঘাটন করে, তা জানার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
এই তদন্ত থেকে এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পেরেছি, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্কালীন প্রধান উপদেষ্টা সাহাবুদ্দীন আহমদের নিয়োগ করা অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক জেনারেল এরশাদ ও চারজন সহ-অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলার আলামত সংগ্রহ ও বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ১৯৯১ সালে ঢাকা থেকে পাঠানো এক খবরে জানায়, ‘এরশাদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও সোনা চোরাচালান মামলা পরিচালনাকারী তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে।’ এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিচারপতি মোহাম্মদ আলী খান ও ফজলে রাব্বীর বাড়িতে অজানা ব্যক্তির চিঠি এসেছে, চিঠিতে খুনের হুমকি রয়েছে। তাঁরা পতিত রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন। মামলার শুনানিও হয়েছিল।’ ঢাকাভিত্তিক পত্রিকা দৈনিক সংবাদ থেকে এপি এই খবরটি সংগ্রহ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রধান কৌঁসুলি আমিনুল হকও একই রকম হুমকি পেয়েছেন।’ এপির প্রতিবেদনটি শেষ হয় এভাবে, ‘আমিনুল হক বলেন, তিনি “এসব হুমকিতে ভীত নন”।’ এই পরিস্থিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির মতে, অজানা টেলিফোন নম্বর থেকে ফোন করে আমিনুল হককে হুমকিটি দেওয়া হয়েছিল।
তবে হুমকিগুলোর বাস্তবতা ছিল। এপির এ প্রতিবেদনের পর অন্তত দুবার তাঁর জীবননাশের চেষ্টা করা হয়। এই ঘটনার পর আমিনুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন, এমন একটি উেসর ভাষ্য হলো, আমিনুল হকের গাড়িতে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। সেদিন গোয়েন্দা বিভাগ থেকে ফোন করে আমিনুল হককে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, তাঁর গাড়িতে বোমা রয়েছে। এরপর তিনি অতিরিক্ত নিরাপত্তা চেয়ে পাঠালে তাঁরা এসে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করে দেন।
জেনারেল মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ একটি মামলা করেন: মঞ্জুর হত্যা মামলা। সে বছরের ২৭ জুন সিআইডি এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তাঁরা হলেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ, মেজর জেনারেল আবদুল লতিফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শামস, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামালউদ্দীন ভূঁইয়া ও মেজর কাজী এমদাদুল হক।
দুই সপ্তাহ পরে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক হঠাত্ হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এরশাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলায় প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে লড়াই করার পর সে সময় তিনি আদালত থেকে সবেমাত্র নিজের দপ্তরে ফিরেছিলেন। তাঁর পরিবার কোনো ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেনি। তবে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার সংশ্লিষ্টদের জন্য এটা ছিল খুব স্বস্তিকর মৃত্যু।
আমিনুল এই মামলায় গতি এনেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। এরপর এই মামলা বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের নাজুক বিচারিক প্রক্রিয়ায় শুধু ঘুরপাক খেয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের নাম মামলার সাক্ষী-তালিকা থেকে রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছে। একটি মামলায় বিচারকের সংখ্যার দিক থেকে এই মামলা সম্ভবত বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে। মামলায় বিচারকদের কাজ যেন কেবল পরবর্তী খেলোয়াড়ের দিকে ‘বলটা ঠেলে দেওয়া’।
মঞ্জুরের পরিবারের জন্য দুই দশক ধরে চলে আসা এই ‘বল ঠেলে দেওয়া’র খেলা দেখা খুব মর্মস্পর্শী ও অমানবিক। এই পরিবারের সদস্যদের কেউ তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন, কেউ তাঁর পিতাকে।
বাংলাদেশের আইন বিভাগের জন্য এই মামলাটি গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত। এর সদর্থক দিকগুলোর জন্য নয়, মামলা পরিচালনায় যেসব পদ্ধতিগত ত্রুটি এ মামলার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে, তার জন্য। এই ‘কেস স্টাডি’র শেষ অধ্যায়টি এখনো লেখা হয়নি।

৫.
‘রাশোমন’-রহস্য
আমরা ছিলাম তিনজন। সবাই নিজের মতো করে সমীকরণটি মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। আমরা বুঝতে চাইছিলাম, ১৯৮১ সালের মে মাসের শেষ দিকে ও জুনের সূচনায় চট্টগ্রামে ঠিক কী ঘটেছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত চার পর্বের লেখাটিতে আমি এই তিন স্বাধীন ব্যক্তির তদন্তগুলোকে একটি সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করেছি।
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী ও চট্টগ্রামের তত্কালীন ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর কাজের সঙ্গে আমার অনুসন্ধানকে একসূত্রে এনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বয়ান তৈরি করা হয় (দেখুন: ‘মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড’, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার, ২২-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
জেনারেল মইন ও জিয়াউদ্দীন দুজনেই এ বিষয়ে বই লিখতে গিয়ে নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাঁদের উদ্ঘাটিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও মতামত ঢালাওভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে জিয়া-হত্যাকাণ্ডের দিন জেনারেল মইন ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। সে সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে টেলিফোনে বার কয়েক কথা বলে তিনি তখন নিশ্চিত হন যে, সে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মঞ্জুরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ঢাকায় মইনের ফ্ল্যাটে তাঁর সঙ্গে আমার দুই দিন কথা হয়। মঞ্জুরকে কেন্দ্র করে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীর সঙ্গে কীভাবে মইন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, সে আলোচনায় ও তাঁর বই এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্যতে তা তিনি বর্ণনা করেছেন। মইন নিশ্চিত ছিলেন যে, এই দুই ব্যক্তি ও তাঁদের সহযোগীরা মঞ্জুরকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আর সেটি ছিল সুপরিকল্পিত একটি ঘটনা। তাঁর বইয়ে মইন বিষয়টি বর্ণনা ‘বিস্তারিত পরিকল্পনা’ বলে।
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর নিজের বইয়ে এবং পরে আমার সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন যে, সেনাপ্রধান এরশাদ ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার মঞ্জুরকে ফাঁসিয়ে দিয়ে একটি মিথ্যা আখ্যান বাজারে ছড়িয়ে দেন। ১ জুন ১৯৮১ হাটহাজারী থানা থেকে নিয়ে আসার পর মঞ্জুর নাকি ‘ক্ষুব্ধ’ সৈনিকদের হাতে মারা পড়েন।